নিউজবাংলা: ২০নভেম্বর-শুক্রবার:
ঢাকা: ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত, প্রধান জল্লাদও চুড়ান্ত। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারা কর্মকর্তাদের দৌড়ঝাঁপ এখন ফাঁসির মঞ্চকে ঘিরেই। মঞ্চের ওপরে টাঙানো হয়েছে শামিয়ানা।
সবারই জানা, এ ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত কাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কারাগারের কনডেম সেলে বন্দী দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপি ও জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের জন্যই। মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ দুই অপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আজকালের মধ্যেই তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে আদালতের রায় কার্যকর করা হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় রায়ের অনুলিপিও এখন কারা কর্তৃপক্ষের হাতে।
গত রাত পৌনে ৯টায় রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আইজি প্রিজনের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছিলেন। কারাগার ঘিরে নেওয়া হয়েছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা। সরকারি সূত্রগুলো বলেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হতে পারে শনিবারের পর যে কোনো দিন। সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা গতকাল কারাগারে গিয়ে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আলাপ-আলোচনা করেছেন পরবর্তী করণীয় নিয়ে। তারা প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা, তা এখনো স্পষ্ট করেননি।
সাকার পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তারা মার্সি পিটিশন বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। অন্যদিকে মুজাহিদ তার পরিবারকে জানিয়েছেন, তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করতে চান। এ জন্য গতকালই কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। সাকা চৌধুরীর পক্ষেও আরও একটি সাক্ষাতের আবেদন করা হলেও কারা কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করে দিয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত দুই অপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর দেখতে দেশের মানুষ যেন অধীর অপেক্ষায় রয়েছে। সারা দেশে বিভিন্ন সংগঠন ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকরের দাবিতে রাস্তায় রাস্তায় মানববন্ধন করেছে। একই দাবিতে শাহবাগে গত রাতে অবস্থান নিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক নেতা জানান, রায়ের কপি কারাগারে গেলেও কার্যকর করতে কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে; যা দ্রুত করা সম্ভব নয়।
পরবর্তী দিন (আজ) শুক্রবার ফাঁসির রায় কার্যকর করা যায় না। এ কারণে শুক্রবারে ফাঁসির রায় কার্যকর হবে না। শনিবার কার্যকর হতে পারে কিনাঃ জানতে চাইলে তিনি বলেন, রায়ের কপি যাওয়ার পর এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবেন কখন রায় কার্যকর করবেন। রায়ের কপি পৌঁছানোর পর শনিবার কিংবা এরপর যে কোনো দিন রায় কার্যকর করতে কোনো বাধা নেই।
তিনি বলেন, সরকার রায় কার্যকর নিয়ে কোনো তাড়াহুড়া করতে চাইছে না। সবকিছুই আদালতের আদেশে রয়েছে। যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও একই নিয়ম মানা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা ছাড়া দেশের দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আর কোনো আবেদনের সুযোগ নেই। আসামিকে নিজ হাতে প্রাণভিক্ষার আবেদনপত্র লিখতে হবে। মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছানোর পর গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তিনি এসব কথা বলেন।
নিরাপত্তা জোরদার : ফাঁসির রায় কার্যকরের আগাম সতর্কতা হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশজুড়ে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাস্তায় টহলে রয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। বিশেষ টহলে রয়েছেন পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রস্তুত রাখা হয়েছে র্যাবের হেলিকপ্টার। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধ মামলার সংশ্লিষ্ট বিচারক, আইনজীবী, সাক্ষী, প্রসিকিউটর এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, সচিবালয়, গুলশান-বনানীর ক‚টনৈতিক জোন, সংসদ ভবন, টেলিভিশন ভবনসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তির নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। গুরুত্ব বিবেচনা করে দেশের বহু স্থাপনায় বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। কারাগারের চারদিকে অন্তত ৫০টি উঁচু ভবনের ছাদে বসানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। কারাগারের চারদিকে প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আশপাশের রাস্তাগুলোয় যানবাহন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধও আরোপ করা হয়েছে। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চলছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও বস্তুতে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে দফায় দফায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। অযাচিত ব্যক্তি ও যানবাহন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
ট্রাইব্যুনাল হয়ে রায় কারাগারে : দেশের দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে এখন কারাগারে। গত রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে রায়ের এ অনুলিপি কারা কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছায়। ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৮১২১ নম্বরের সিলভার কালারের একটি মাইক্রোবাসে করে ট্রাইব্যুনালের পাঁচ কর্মকর্তা এ অনুলিপি পৌঁছিয়ে দেন। এর আগে সন্ধ্যা ৭টা ২৪ মিনিটে রায় দুটি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে যায় ট্রাইব্যুনালে। সুপ্রিমকোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তিনজন অনুলিপি পৌঁছে দেন। কারাসূত্র জানান, রায় দুটি পড়ে শোনানো হবে মুজাহিদ ও সাকাকে। এর আগে বিকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির সাজা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপিতে প্রধান বিচারপতিসহ রায় প্রদানকারী চার বিচারপতি সই করেন। রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপিতে গতকাল বিকালে সইয়ের পরই তা প্রকাশ করা হয়।
সাকা চৌধুরীর বিচার : মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় ২০১০ সালের ২৬ জুলাই। এর আগে অবশ্য নাশকতার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা হয় ২৬ জুন। ওই মামলায় একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর গ্রেফতার হন তিনি। পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দেখানো হয় তাকে। ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল ২৩ অভিযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে সাকা চৌধুরীর বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন সাকা চৌধুরী। আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয় ১৬ জুন। ২৯ জুলাই দেওয়া রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। সে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর সাকা রিভিউ আবেদন করেন। সে আবেদনও খারিজ হয় বুধবার।
মুজাহিদের বিচার : ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার হন মুজাহিদ। ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতারের পর একই বছর ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দেখানো হয় তাকে। ২০১২ সালে মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। তার বিচার শুরু হয় ২০১২ সালের ২১ জুন। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন মুজাহিদ। আপিলের শুনানি শুরু হয় গত ২৯ এপ্রিল। ১৬ জুন দেওয়া রায়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। সে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর মুজাহিদ রিভিউ আবেদন করেন। সে আবেদনও খারিজ হয় বুধবার।
নিউজবাংলা/একে:
Comments
comments