নিউজবাংলা- ১৬ নভেম্বর,সোমবার:
ফেনী: মামলা আর দলাদলিতে জেরবার ফেনী জেলা বিএনপি। দল পুনর্গঠনে কেন্দ্র থেকে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও নেতাদের দ্বিধাবিভক্তির কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি।
তৃণমূল পুনর্গঠনে কেন্দ্র থেকে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে জেলা তো দূরে থাক, উপজেলা কিংবা পৌরসভা কমিটি গঠনে কোনো অগ্রগতি নেই। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ-অসন্তোষ।
শুধু বিএনপি নয়, অঙ্গসংগঠনগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে ফেনীতে। সব মিলিয়ে অনেকটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা খালেদা জিয়ার জেলায় দলীয় কার্যক্রমের।
বিএনপি
ফেনীর দুটি আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ও অধ্যাপক জয়নাল আবদীন ভিপির নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে দিয়ে ২০০৯ সালে দলীয় চেয়ারপারসনের ছোট ভাই ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দারকে সভাপতি ও জিয়াউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মোশাররফ-ভিপি জয়নালপন্থীদের কোণঠাসা করে দল পুনর্গঠন করা হয়।
গাজী হাবিবউল্লাহ মানিককে সভাপতি ও আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারীকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা যুবদলের কমিটি করার পর দলীয় কর্মসূচি পালনে এ দুজনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ফেনী বিএনপি। মানিক প্রচার সম্পাদক ও আনোয়ার ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদ পেলে বিএনপির নীতিনির্ধারণেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখে যুবদল।
সাঈদ এস্কান্দার ও মোশাররফ হোসেনের মৃত্যুর পর জয়নাল আবদীন ভিপি ও রেহানা আক্তার রানু এ দুই মেরুর নেতৃত্বে আসেন।
স্থানীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে দীর্ঘদিন ঢাকায় অবস্থান করছেন ভিপি জয়নাল। রানু ঢাকায় অবস্থান করলেও তার ইশারায় চলে ফেনী বিএনপির সব কার্যক্রম। ছাত্রদলের কমিটি গঠনও হয় রানুর পছন্দমতো।
নঈম উল্লাহ চৌধুরী বরাতকে সভাপতি, এস এম কায়সার এলিনকে সিনিয়র সহসভাপতি ও সালাহউদ্দিন মামুনকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করা হলেও ভিপি জয়নাল-সমর্থিতরা মেজবাহ উদ্দিনকে সভাপতি ও এস এম কায়সার এলিনকে সাধারণ সম্পাদক করে তৃণমূল ছাত্রদল নামে পাল্টা কমিটি গঠন করে।
এদিকে মানিক-আনোয়ারের সম্পর্কে চিড় ধরলে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পৃথকভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করে তাদের সমর্থকরা। এ ছাড়া আছে মামলায় জড়িয়ে নেতাদের আত্মগোপনে থাকা।
সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তিন ডজন মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে আছেন গাজী মানিক। একইভাবে আনোয়ার পাটোয়ারী, নঈম উল্লাহ চৌধুরী বরাতও ২৫-২৬টি মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে। জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন মিষ্টারের নামে রয়েছে তিনটি মামলা। তারা দীর্ঘদিন কারাভোগ শেষে কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। জেলা পর্যায়ের অন্য নেতাদের মধ্যে সর্বাধিক মামলা নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন সদর উপজেলা সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান বকুল, পৌর সভাপতি আলাল উদ্দিন আলাল। দীর্ঘদিন উপজেলা পর্যায়ের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দেখা পান না কর্মীরা। মোবাইল ফোনও বন্ধ রেখে তারা অনেকটা লাপাত্তা হয়ে আছেন।
আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সরকারবিরোধী আন্দোলন-কর্মসূচিতে সিনিয়র নেতাদের মাঠে সক্রিয় থাকার কেন্দ্রীয় নির্দেশনা থাকলেও জেলা নেতাদের সক্রিয় দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, বিগত উপজেলা নির্বাচনেও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপির দুর্গ হিসেবে খ্যাত এ জেলার সব কটি উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে কোনো জয় পায়নি দলীয় প্রার্থীরা।
দল পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গত ১০ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহাজাহান সারা দেশের মতো ফেনী জেলা বিএনপির কাছেও চিঠি পাঠান। ওই চিঠির আলোকে সব কটি উপজেলা ও পৌর নেতাদের সঙ্গে জেলা নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট শাখার নেতাদের কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ওই নির্দেশ কোনো আলোর মুখ দেখেনি। প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার ইশারা না পাওয়ায় কোনো শাখায় কাউন্সিল করতে আগ্রহ দেখায়নি স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা। এ ছাড়া সদর ও সোনাগাজীতে অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে মতবিনিময় সভাতেও বিশৃঙ্খলা হয়। এতে করে জেলা বিএনপিতে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার পাশাপাশি একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বর্তমান জেলা বিএনপির কমিটি সরকারদলীয় এক শীর্ষ নেতার ইশারায় চলে। ওই নেতা যাতে অখুশি না হন, সে জন্য এবার ১৫ আগস্টে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনও তার নিজ জেলা ফেনীতেও পালন করেনি বিএনপি। তবে ছাত্রদল ও অন্যরা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কর্মসূচি পালন করে।
নেতাকর্মীরা জানান, ত্যাগী, যোগ্য ও পরিশ্রমী নেতাদের মূল্যায়ন করে কমিটি পুনর্গঠন করা না হলে ফেনী বিএনপি দেউলিয়া হয়ে পড়বে। নতুবা বেগম খালেদা জিয়ার নিজ জেলায় দলের অস্তিত্ব মহাসংকটে পড়বে বলে মনে করছেন তারা।
যুবদল
প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছরের মধ্যে গত ২২ বছর ধরে যুবদলের ফেনী পৌর শাখার কমিটি নেই। ১৯৯৩ সালে জেলা যুবদলের তৎকালীন সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক রেজা আহমদ কেটু একটি কমিটি ঘোষণা দেন। ওই কমিটিতে আলাউদ্দিন পাইলটকে সভাপতি ও আবুল বসরকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। এরপর আর কোনো কমিটি গঠন হয়নি। তবে জাহিদ হোসেন বাবলু, দেলোয়ার হোসেন ও হায়দার আলী রাসেল পাটোয়ারী নিজেদের পৌর যুবদলের সমন্বয়ক বলে পরিচয় দেন।
২০০৮ সালে গাজী হাবিব উল্লাহ মানিককে সভাপতি ও আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারীকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠনের পর পৌর কমিটি গঠনে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও দলাদলির কারণে কমিটি গঠন আলোর মুখ দেখেনি। জেলা সদরও চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। তিন মাসের অনুমোদিত এ কমিটি চলছে প্রায় ৭ বছর ধরে। ফুলগাজীতেও কমিটি নেই দীর্ঘদিন ধরে। মানিক-আনোয়ার সম্পর্কে ছিড় ধরলে নির্জীব হয়ে পড়ে বিএনপির আন্দোলনের ভ্যানগার্ড খ্যাত যুবদল। পৃথক কর্মসূচি পালন করেন মানিক-আনোয়ার। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে জেলার সাংগঠনিক কার্যক্রম। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি পুনর্গঠনের কাজ দলাদলি আর অনৈক্যের কারণে বেশিদূর এগোয়নি। এতে করে থমকে আছে যুবদল-ছাত্রদলসহ সহযোগী সংগঠনগুলো। গত কদিন আগে বিএনপির চেয়ারপারসনের সুস্থতা কামনায় যুবদলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিও জেলার কোথাও পালন হয়নি।
ছাত্রদল
কিছুতেই ‘ঘরানা’ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল। কমিটি গঠনের ধারাবাহিকতা না থাকা, নেতাদের অনৈক্যসহ নানা কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়ে আছে।
২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নঈম উল্লাহ চৌধুরী বরাতকে সভাপতি, এস এম কায়সার এলিনকে সিনিয়র সহসভাপতি ও সালাহ উদ্দিন মামুনকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর এস এম কায়সার এলিন পদত্যাগ করে ‘তৃণমূল ছাত্রদল’ নামের বিদ্রোহী কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির সভাপতি হন সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মেজবাহ উদ্দিন। তৃণমূল কমিটি ইতিমধ্যে সদর উপজেলা ও ফেনী পৌর শাখার কমিটি গঠন করে। কেন্দ্র ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচি এমনকি খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন হয়েছে পাল্টাপাল্টি।
কেন্দ্র ঘোষিত কমিটি গঠনের দুই বছর পার হতে চললেও সদর উপজেলা ছাড়া পূর্ণাঙ্গ কমিটি কিংবা অপর পাঁচ উপজেলা ও পৌর কমিটি গঠন করতে পারেনি। বিগত বছরে জেলার ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ফেনী সরকারি কলেজেও কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই। তবে দীর্ঘদিন রাজপথে থাকা নেতারা পদ পেতে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতায় বিএনপি আহূত সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল সমালোচিত।
সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ছাত্রদল বিএনপির সব ধরনের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে ছাত্রদলের সভাপতি নঈম উল্লাহ চৌধুরী বরাত। তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি ও বিভিন্ন কমিটি গঠনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও পুলিশের হয়রানিকে দায়ী করেছেন।
তবে ভিন্ন কথা বলছেন যুবদলের সভাপতি গাজী হাবিব উল্লাহ মানিক। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে কমিটি পুনর্গঠন জেলা নেতাদের যোগ্যতা ও সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। তবে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের নিয়ে সব কটি ইউনিটের কমিটি গঠনের দাবি জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন আহমদ মিষ্টার বলেন, “কমিটি গঠন প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যে জেলার সব কটি ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষ হয়েছে। ম্যাডাম (বেগম খালেদা জিয়া) দেশে ফিরলেই কমিটি গঠন চূড়ান্ত হবে।”
নিউজবাংলা/একে
Comments
comments