আশুরার যা যা করণীয়

নিউজবাংলা: ২৩ অক্টোবর, শুক্রবার:

ঢাকা: হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের ১০ তারিখকে ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় আশুরা বলা হয়। ইসলাম ধর্মে আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বিখ্যাত ও শিক্ষণীয় ঘটনা ঘটেছিল এ দিনটিতে। এ দিনে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাবলি থেকে যেমন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আছে, তদ্রূপ ইসলামী শরিয়া মোতাবেক এদিনে কিছু করণীয়ও রয়েছে। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে এদিনের শিক্ষা ও করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
আশুরার শিক্ষা
আশুরার দিনে পৃথিবীর ইতিহাসে আল্লাহ তায়ালা যে মহান ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন মানব সম্প্রদায়ের জন্য তাতে অনেক শিক্ষা রয়েছে। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি (রহ.) বলেন, এদিনে আল্লাহ তায়ালা ১০ জন নবীকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন বিধায় এদিনকে আশুরা বলা হয়। (উমদাতুল কারী, খ. ১৭, পৃ. ১৩৫)। ওই ১০ জন নবীর কাহিনী থেকে আমরা নানা ধরনের শিক্ষা পেয়ে থাকি। যেমন-
* অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্যও তওবা করতে হবে : আদি পিতা আদম (আ.) জান্নাতে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করেন। পরে আল্লাহ তায়ালার শেখানো কালেমা দ্বারা ক্ষমা প্রার্থনা করলে দীর্ঘ দিন পর আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেন। সে দিনটি ছিল আশুরার দিন। বোঝা গেল অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্যও তওবা করতে হবে।
* নবীদ্রোহীদের ধ্বংস অনিবার্য : নুহ (আ.) দীর্ঘ ৯৫০ বছর উম্মতকে তাওহিদের দাওয়াত দেন। তার ডাকে মাত্র ৮০ জন পুরুষ ও মহিলা সাড়া দেন। বাকিরা তার ডাকে সাড়া না দিয়ে অত্যাচার করতে থাকে। নুহ (আ.) বদদোয়া দিলে মহাপ্লাবন দিয়ে তাদের ধ্বংস করে দেয়া হয়। আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহে নুহ (আ.) এবং তার সাথীদের একটি নৌকায় উঠিয়ে হেফাজত করেন। প্লাবন শেষে নৌকাটি আশুরা দিবসেই জুদি পর্বতে নোঙর করে। নবীদ্রোহীরা সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়।
* খোদাদ্রোহী শক্তির পতন অনিবার্য : ইরাকের বাবেল শহরে মূর্তিপূজারি নমরুদ খোদা দাবি করে। তাকে পতনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম (আ.)কে প্রেরণ করেন। ইবরাহিম (আ.) কোনো এক আশুরা দিবসেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং পরে তার কাছেই নমরুদের পতন হয়। ইবরাহিম (আ.) এর জন্মদিন আশুরা দিবসই খোদাদ্রোহী শক্তি নমরুদের পতনের সূচনা দিন ছিল।
* নবীদের মোজেজা সত্য : প্রিয় সন্তান ইউসুফ (আ.) কে হারিয়ে ইয়াকুব (আ.) কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরে মিসর থেকে ইউসুফ (আ.) তার গায়ের জামা পাঠিয়ে দেন। আশুরা দিবসে জামাটি চোখের ওপর রাখতেই তিনি পুনরায় দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। প্রমাণিত হলো, নবীদের মোজেজা সত্য।
* রাখে আল্লাহ মারে কে : ইউসুফ (আ.) স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, ১১টি নক্ষত্র এবং চন্দ্র ও সূর্য তাকে সেজদা করছে। স্বপ্নটি তিনি পিতা ইয়াকুব (আ.) এর কাছে বললেন।
ইয়াকুব (আ.) স্বপ্নের মাহাত্ম্য বুঝতে পেরে ইউসুফ (আ.) কে একটু বেশি ভালোবাসতে লাগলেন। ইউসুফ (আ.) এর সৎভাইয়েরা বিষয়টি অন্যভাবে দেখল এবং তাকে হত্যার পরিকল্পনা করল। তারা ইউসুফ (আ.) কে পিতা ইয়াকুব (আ.) এর কাছ থেকে চিরতরে দূরে সরিয়ে দিতে বনের গহিনে একটি কূপে ফেলে দেয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মিসরের একটি ব্যবসায়ী কাফেলার মাধ্যমে আশুরা দিবসেই তাকে সে কূপ থেকে উদ্ধার করেন। প্রমাণ হলো, রাখে আল্লাহ মারে কে?
* সত্যের বিজয় : মিসরের বাদশা ফেরাউন খোদা দাবি করে এবং বনি ইসরাইলকে দাস বানিয়ে রাখে। আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনকে হেদায়েত করার জন্য এবং বনি ইসরাইলকে উদ্ধার করার জন্য হজরত মুসা (আ.) কে মিসরে পাঠান। মুসা (আ.) শত চেষ্টা করেন। ফেরাউন মুসা (আ.) কে জাদুকর আখ্যা দেয়। কিন্তু দেশবরেণ্য জাদুকররা মুসা (আ.) এর সত্যতা বিশ্বাস করে তার ওপর ঈমান আনে। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে মুসা (আ.) রাতের অাঁধারে বনি ইসরাইলকে নিয়ে মিসর থেকে হিজরত করলে ফেরাউন তার দলবলসহ মুসা (আ.) এর পিছু ধাওয়া করে। নীল নদ সামনে এলে মুসা (আ.) হাতের লাঠি দ্বারা পানিতে আঘাত করতেই আল্লাহর নির্দেশে পানিতে ১২টি রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। মুসা (আ.) বনি ইসরাইলকে সঙ্গে নিয়ে নদ পার হয়ে ওপারে চলে যান। পক্ষান্তরে, পিছু ধাওয়াকারী ফেরাউন ও তার দলবল নদের মাঝখানে এলেই আল্লাহর নির্দেশে নদ আবার আগের মতো হয়ে যায়। ফলে নীল নদেই তাদের সলিল সমাধি হয় এ আশুরা দিবসেই। সত্য বিজয়ী হয় আর মিথ্যা পদানত হয়।
* যে কোনো পরীক্ষায় আল্লাহর কাছে এস্তেগফার করা : আল্লাহ তায়ালা দাউদ (আ.) কে একটি পরীক্ষায় ফেলেন। তিনি আল্লাহর কাছে এস্তেগফার করলে আশুরা দিবসেই আল্লাহ তায়ালা তাকে করুণা করেন। যে কোনো পরীক্ষায় আল্লাহর কাছে এস্তেগফার করা আশুরার শিক্ষা।
* দোয়া কবুল : ইউনুস (আ.) কে জাহাজের আরোহীরা লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত করে সাগরে ফেলে দিলে একটি মাছ এসে তাকে গিলে ফেলে। ইউনুস (আ.) মাছের পেটে অবস্থান করেই আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতে থাকেন। দোয়াটি ‘দোয়ায়ে ইউনুস’ নামে পরিচিত। দীর্ঘ ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর আশুরা দিবসেই আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করেন এবং তাকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দেন। ফলে মাছ তাকে একটি উপকূলে এসে উদগিরণ করে দেয়। বলা যায়, আশুরা দোয়া কবুলের দিবস।
* আল্লাহর সাহায্য লাভ : ঈসা (আ.) ইঞ্জিলের বাণীর মাধ্যমে পথভ্রষ্ট ইহুদিদের আল্লাহর দিকে ডাকেন। কিন্তু হতভাগা ইহুদিরা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং সে উদ্দেশে তারা ঈসা (আ.) কে একটি ঘরে বন্দি করে। ঈসা (আ.) আল্লাহ তায়ালার সাহায্য কামনা করলে ঘরের ছাদ ফাটিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাকে আকাশে উঠিয়ে নেন। ঘটনাটি ঘটেছিল আশুরা দিবসেই। তাই বলা যায়, এ দিবস আল্লাহ তায়ালার সাহায্য লাভের দিবস।
* মহানবী (সা.) এর শ্রেষ্ঠত্ব : আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা.) এর পূর্বাপর সব ত্রুটির অগ্রিম মার্জনার ঘোষণা আশুরা দিবসেই প্রদান করেছিলেন। এটি ছিল মহানবী (সা.) এর শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দিক, যা উম্মতে মুহাম্মদির গর্বের কারণ। (আল্লামা আইনির উমদাতুল কারি অনুসরণে, খ. ১৭, পৃ. ১৩৫ দ্রষ্টব্য)।
* সত্যের ওপর অবিচল থাকা এবং অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা : হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম আশুরা দিবসে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে স্বৈরাচার এজিদ বাহিনীর হাতে নবীদৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) সপরিবারে নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। খেলাফতের যোগ্য উত্তরাধিকারী হয়েও একজন পাপাচারীকে খলিফা বলে মেনে না নেয়াই ছিল ইমাম হোসাইন (রা.) এর অপরাধ। এজিদের শত অত্যাচার ও নিপীড়নকে উপেক্ষা করে গেছেন ইমাম হোসাইন (রা.)। তবুও মাথানত করেননি। আশুরা দিবসে তিনি শহীদ হয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, সত্যের ওপর অবিচল থাকতে হবে এবং অসত্য যতই মারাত্মক হোক না কেন, তার সঙ্গে কখনও আপস করা যাবে না, বরং রুখে দিতে হবে অসত্যের জোয়ারকে।
লেখক : প্রধান মোহাদ্দেস
দারুননাজাত কামিল মাদরাসা, ঢাকা

নিউজবাংলা/একে

Share This:

Comments

comments

Previous: নবায়ন করা যাবে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ
Next: রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দাবিতে বিক্ষোভ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*