নিউজবাংলা: ৩জুলাই, শুক্রবার:
ঢাকা: জীবনের কষাঘাতে কেউ এমন আদিম পেশাকে বেছে নিলেও এর থেকে আবার তারা বেরিয়ে আসতে চায়। সেই ইচ্ছাটাকে কাজে লাগাতে পারলেই জীবনটাকে আবার নিজের মতো করে উপভোগ করা যায়। এমনই এক জীবনের গল্প বলেছেন, স্বয়ং ব্রেন্ডা মেয়ারস পাওয়েল।
জীবনের শুরুতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন যৌন কর্মী হতে। ২৫ বছর পর সেই জীবন থেকে বেরিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘ড্রিম ক্যাচার’ ফাউন্ডেশন। কাজ করে যাচ্ছেন সেই সব মেয়েদের ভাগ্যোন্নয়নে, যারা বাধ্য হয় যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন । তিনি শুনিয়েছেন যৌনকর্মী থেকে সমাজকর্মী হয়ে ওঠার সেই গল্প।
ব্রেন্ডা বলেন, ১৯৬০ সালে শিকাগোর পশ্চিমে একটি শহরতলীতে আমার জন্ম। ৬ মাস বয়সেই মাকে হারিয়েছি। আমি বড় হয়েছি আমার দাদির কাছে। তিনি ভালো একজন মানুষ ছিলেন। তবে তিনি প্রচুর নেশা করতেন। প্রায়ই বার থেকে তার বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। দাদি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার বন্ধুদের দ্বারা আমি প্রায়ই শারীরিকজভাবে লাঞ্ছনার শিকার হতাম। আমার বয়স তখন সবে চার কী পাঁচ বছর। আমার দাদি এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
‘আমি আমাদের বাড়ির পাশে ঝলমলে রঙের পোশাক পরে সুন্দর সাজের কিছু নারীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। আমি জানতাম না তারা সেখানে কী করে। একদিন দাদিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন ‘মেয়েগুলো তাদের প্যান্টি খুলে দেয়, বিনিময়ে লোকেরা তাদের টাকা দেয়।’ আমি মনে মনে ভাবলাম আমিও বোধ হয় ওদের মতোই একজন, কারণ ইতিমধ্যেই লোকেরা আমার প্যান্টি খুলেছে অনেক বার।’
ব্রেন্ডা বলেন, আমার বয়স যখন ১৪ তখন থেকেই দাদি আমাকে বাড়ি টাকা দিতে বলছিল, কারণ বাড়িতে খাওয়ার কিছুই ছিল না। সেদিন ছিল শুক্রবার। সন্ধ্যায় আমি মার্ক টুইন হোটেলের সামনে রাস্তায় দাঁড়ালাম। আমি চার ডলারের সস্তা টু পিস, একটি প্লাস্টিকের জুতো আর কমলা রঙের লিপিস্টিক দিয়ে সেজেছিলাম, যেন আমাকে কিছুটা বয়স্ক দেখায়। সেদিন পাঁচজনের সঙ্গে আমি শুয়েছিলাম। আমার বয়স ছিল মাত্র ১৪। আমি কিছুই জানতাম না। তবে তারা আমায় শিখিয়েছিল কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়। সেদিন আমি ৪০০ ডলার আয় করেছিলাম। অধিকাংশ ডলারই আমি দাদিকে দিয়ে দিয়েছিলাম। ডলার দেওয়াতে দাদি খুব খুশি হয়েছিল। তবে তিনি কখনো জানতেও চাননি, এই ডলার কোথায় পেলাম আমি।
তৃতীয় বারের মতো আমি যখন সেখানে গেলাম, পিস্তলওয়ালা তিনজন যুবক আমাকে জোর করে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। প্রথমে তারা আমাকে একটা মাঠে নিয়ে ধর্ষণ করল এবং তারপর একটা হোটেলের ছোট্ট রুমে আটকে রাখল। পরে তারা আমাকে দিয়ে জোর করে ছয় মাসের মতো যৌন ব্যবসা করিয়েছে। বিষয়টি যথেষ্ট শারীরিক এবং মানসিক কষ্টের। আমি বের হতে চাইলে তারা আমাকে প্রচণ্ড মারধর করত। তারপর তারা আমাকে আর এক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। এভাবে ২৫ বছর আমাকে যৌনদাসী করে রাখা হয়েছে। এই ২৫ বছরে কেউ আমার কাছে কখনো ফুল নিয়ে আসেনি। তারা শুধু আমার শরীরটাকে একটা বাথরুমের মতো ব্যবহার করেছে। তারা এমন ব্যবহার করত, যেন তাদের সমস্ত রাগ ক্ষোভ এই পতিতার উপর।
১৯৯৭ সালের ১ এপ্রিল। আমার বয়স তখন প্রায় ৪০। এক কাস্টমার সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে তার গাড়ি থেকে ছুড়ে ফেলে দিল। আমি মারাত্মকভাবে যখম হয়েছিলাম। আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম কিন্তু তারা আমার পরিচয় জানার পর আমাকে ইমার্জেন্সি রুম থেকে বের করে দিয়েছিল- যেন একজন পতিতার ইমার্জেন্সি রুমের সেবা পাওয়ার অধিকার নেই। পরে একজন নারী চিকিৎসক আমার কাছে এসে আমাকে সেবা দিলেন এবং আমাকে একটি মাতৃসদনের ঠিকানা দিয়ে সেখানে যেতে বললেন।
এডুইনা গেটলে নামের এক অসাধারণ ইংরেজ ভদ্র মহিলা মাতৃসদনটা চালাতেন। তিনি আমায় সুস্থ করে তুলেছিলেন, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং আমার যতদিন ইচ্ছা, সেখানে থাকতে বলেছিলেন। এখানে আমি শিখেছিলাম কীভাবে পারস্পরিক ভালোবাসা এবং সহযোগিতা একটা মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। আমি বছর দুয়েকের মতো সেখানে থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শিকাগোর সেই শহরতলীতে ফিরে এলাম।
আমার সেই দুঃসহ জীবন থেকে ফিরে আমি যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের গবেষকের কাজে সাহায্য করা শুরু করলাম। তবে আমি তাদের কাজে সন্তুষ্ট ছিলাম না।
সুস্থ হয়ে ওঠার তিন বছর পর ড্যানিয়েল উইলসন নামে একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো আমার। সে আমার অতীত নিয়ে কখনো কথা বলত না। কিন্তু দারুণ ভালোবাসত। আমি এবং উইলসন ‘ড্রিম ক্যাচার’ নামে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুললাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যারা যৌনকর্মী হতে বাধ্য হয়েছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। আর আমরা সেই সব ধারণাকে ভেঙে দিতে চাই, যারা বলে ‘তোমাদের জন্ম হয়েছে পতিতাবৃত্তি করার জন্য এবং তোমরা এর থেকে বের হতে পারবে না।’
এখনো যে মেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে তাদের শরীর বিক্রির জন্য, তাদের কাছে আমরা যাই আর বলি ‘তোমরা চাইলে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি, তুমি চাইলে এই দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পার।’
এখন পর্যন্ত ১৩ জন মেয়েকে আমরা তাদের দুঃস্বপ্নের পৃথিবী থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। তারা সবাই আমাদের কাছে এসেছিল যখন তাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছর। স্কুল পাস করে এখন বিভিন্ন কলেজে বিনা পয়সায় পড়ালেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে তাদেরকে।
সম্প্রতি কিম ল্যাংগিনেটো আমাদের সংগঠন ‘ড্রিম ক্যাচার’-কে নিয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেছেন। আমাদের কর্মকাণ্ড সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এখন আমার বয়স ৫৮। কিছুদিন আগে আমি আর উইলসন আমাদের দশম বিবাহ বার্ষিকী পালন করেছি। উইলসন আমাকে সব সময় সমর্থন করেছে। আমার মেয়েরা একজন ডাক্তার আর একজন আইনজীবী। আমি আমার এক ভাতিজিকে দত্তক নিয়েছি। আমি এখন একজন মা। আমি আপনাদের একটি কথাই বলতে চাই, অনেক ধ্বংস, বাধাবিপত্তির পরও জীবনটা উপভোগের। আমি জীবনের কোনো ক্ষুদ্র অংশের কথা বলছি না, পুরো জীবনটাই উপভোগের। তাই পেছনে না ফিরে আপনার মতো করে জীবনটাকে উপভোগ করুন।