নিউজবাংলা: ০৮ আগস্ট, শনিবার:
ঢাকা: সুমিতেরি তানিগুচির ৮৬ বছর বয়সী বৃদ্ধ দেহটিতে মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে পরমাণু বোমার আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত। গত ৭০ বছর ধরেই তিনি এই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।

১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট জাপানের বন্দর নগরী নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার আঘাতে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও বেঁচে থাকা লাখ লাখ মানুষদের একজন তিনি।

তিনি এখনো নিজের বাম হাতটি পুরোপুরি সোজা করতে পারেন না। তাঁর স্ত্রী প্রতিদিন সকালেই তার ক্ষতগুলোতে মলম লাগিয়ে দেন জ্বালা কমানোর জন্য।

পরমাণু বোমার আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতে তার পাঁজরের তিনটি হাড় ক্ষয়ে গেছে। ওই ক্ষত এখন তার ফুসফুসেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে তার হাড় জিরজিরে বক্ষে অস্বাভাবিক কিছু গর্ত এবং চামড়া ফোলাও দেখা দিয়েছে।
নাগাসাকি হামলায় বেঁচে যাওয়া মানুষদের নিয়ে গঠিত তার নেতৃত্বাধীন একটি দলকে নিয়ে তিনি পরমাণু দূষণবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবেই তিনি তার এই ক্ষত প্রদর্শন করেন। তিনি এবং তার দলটি চায় যে ভবিষ্যতে কাউকে যেন আর কখনোও পরমাণু বিস্ফোরণে সৃষ্ট ক্ষতের যন্ত্রণায় ভূগতে না হয়।

যেদিন জাপানের কিয়ুশু দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমপার্শ্বে অবস্থিত নাগাসাকি শহরের আকাশে ভূমি থেকে মাত্র ৫০০ মিটার উচ্চতায় পাঁচ টন প্লুটোনিয়ামে তৈরি ফ্যাটম্যান নামের পরমাণু বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয় সেদিন মি. তানিগুচির বয়স ছিল মাত্র ১৬। নাগাসাকি ছিল জাপানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর একটি। বন্দরটি ছিল চীনের সাংহাইয়ে আসা-যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি ট্রানজিট রুট।

সেদিন দুপুরের মাত্র দু্ই মিনিট পরে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর মাত্র তিনদিন আগে আরেকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল হিরোশিমাতে। ওই দু’টো পারমাণবিক বোমা হামলায় সবমিলিয়ে ২ লাখ ২৬ হাজার মানুষ নিহত হয়।

সেদিন চিঠি বিতরণের জন্য সাইকেলে চড়ে বাড়িবাড়ি যাচ্ছিলেন মি. তানিগুচি। পারমাণবিক বোমাটির বিস্ফোরণের তোড়ে তিনি সাইকেল থেকে পড়ে যান। পারমাণবিক বোমাটির বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরে ছিলেন তিনি। ওই পারমাণবিক হামলায় নাগাসাকির ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়।

বিস্ফোরণে ঝলসে যাওয়ার পর তানিগুচি ধোঁয়া ও ধুলাবালির মিশ্রনে সৃষ্ট কুয়াশায় দিশেহারা হয়ে প্রায় তিনদিন ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি এতটাই হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে নিজের দেহের ক্ষতের ভয়াবহতা সম্পর্কে তার কোনো হুঁশজ্ঞানই ছিল না।

প্রথমে তার মনে হচ্ছিল তার গায়ে বুঝি পিঠ, কাঁধ ও বাহু থেকে ছিন্নভিন্ন একটি পোশাক ঝুলে রয়েছে। পরে তিনি বুঝতে পারেন সেটি কোনো পোশাক নয় বরং তার শরীরের ঝলসানো চামড়াই ওভাবে ঝুলে ছিল।

চিকিৎসা স্বেচ্ছাসেবীরা তাকে উদ্ধারের পরবর্তী প্রায় ২১ মাস ধরে তিনি নিজের পাকস্থলীর উপরই শুয়ে কাটিয়ে দেন। এসময় তাকে ঝলসে যাওয়া পিঠ, মাংসপেশি এবং ক্ষয়ে যাওয়া হাড়গুলো সারিয়ে তোলার জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়।

পুরো সময়টাজুড়ে তিনি আধা হুঁশে ছিলেন। চিকিৎসা গ্রহণের সময় তার ব্যাপারে নার্সদের কথোপকথন শুনতে পেতেন তিনি। নার্সরা তার রুমের বাইরের হলরুম অতিক্রম করার সময় পরস্পরকে ভেতরের ছেলেটি এখনো শ্বাস নিচ্ছে কি না সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করত।

চিকিৎসার জন্য এত দীর্ঘ সময় ধরে নিশ্চল ও নিথর হয়ে পড়ে থাকার ফলে তার কিশোর বাহুগুলোর হাড় বুড়িয়ে যায় এবং দেহের সঙ্গে জোড়াটি ব্লক করে দেয়। যার ফলে বাকী জীবন তাকে একটি অচল হাত নিয়েই কাটিয়ে দিতে হয়।
দ্বিতীয় পরমাণু হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জাপানিদেরকে চুড়ান্তভাবে অপদস্থ করার জন্য মার্কিন জঙ্গি বিমানগুলো থেকে লাখ লাখ লিফলেট বিতরণ করা হয়। লিফলেটগুলোতে জাপান যদি শিগগিরিই যুদ্ধ বন্ধ না করে তাহলে ফের পরমাণু হামলার হুমকি দেওয়া হয়। এর মাত্র ৬ দিন পরই জাপান আত্মসমর্পন করে।

ওই ভয়াবহ পরমাণু বোমা হামলার ৭০ বছর পর আজ নিজের শরীরের ক্ষতগুলো দেখানোর সময় দূর্বল ও শ্বাসকষ্টজনিত কারণে ক্ষীণ হয়ে আসা স্বরে মি. তানিগুচি বলছিলেন, ‘আমি চাই এখানেই এর শেষ হোক।’ এই বলতে বলতে তিনি ক্ষতগুলো ঢাকার জন্য পূণরায় শার্টটি গায়ে চড়িয়ে দেন।

নিউজবাংলা/একে