নিউজবাংলা: ০৮ আগস্ট, শনিবার:
ঢাকা: মৌমিতা (ছদ্মনাম)। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্রী। থাকেন ধানমন্ডি শঙ্কর এলাকার একটি বাসায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথমদিকে সচেতন থাকলেও হঠাৎ তরুণীটি বুঝতে পারেন ‘সর্বনাশ’ হয়ে গেছে তার। তিনি মা হতে চলেছেন। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ভয়ে কিছুদিন একঘরে হয়ে থাকেন নিজেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষায় যেতেন না। বিষয়টি তার সেই প্রেমিককে জানালে তিনিও প্রথমে ভয় পান। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হয় মোহাম্মদপুরের নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে ‘বিবাহিত’ পরিচয় দিয়ে তিনি গর্ভপাত করান। এজন্য তাকে প্রায় ৩ হাজার টাকাও খরচ করতে হয়। গর্ভপাতের পর কয়েকদিন অসুস্থ থাকলেও বিষয়টি পরিবার বা বন্ধুদের কারো কাছে ফাঁস করেননি।
শিল্পী আক্তার (ছদ্মনাম)। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকেন। বছর কয়েক আগে বিয়ে হয়েছিল তার। কয়েক মাস যেতে না যেতেই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। এরপর আর বিয়ে করেননি। অফিসেরই এক কলিগের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর তারা একসঙ্গে ঘুরতে যান কক্সবাজারে। সেখানেই শারীরিক সম্পর্ক হয় ওই কলিগের সঙ্গে। পূর্ব-অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ভেবেছিলেন তার ‘সেইফ পিরিয়ড’ চলছে। কিন্তু পরবর্তী পিরিয়ডের সময় বুঝতে পারেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে চিকিৎসক জানান, তিনি মা হতে চলেছেন। পরে আজিমপুরের সরকারি মাতৃসদনে গিয়ে এক আয়ার মাধ্যমে গর্ভপাত করান তিনি। এজন্য তাকে খরচ করতে হয় ১৫০০ টাকা। তিনিও বিষয়টি পরিবারের কারো সঙ্গে শেয়ার করেননি।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রতিদিনই গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে। বেশির ভাগই গর্ভপাত করছে অবিবাহিত মেয়েরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গর্ভপাতের এই হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন অলিগলি ও ময়লার ডাম্পিং স্টেশনে প্রায়ই অপরিণত শিশুর ভ্রুণ পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে রাজধানী ঢাকায় অন্তত দুই ডজন অপরিণত নবজাতকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলাও দায়ের হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন মাস বয়সের আগেই ভ্রূণ বিনষ্ট বা গর্ভপাত করা হলে সাধারণত টের পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে ভ্রূণের আকৃতি একটি গোলকার পিণ্ডের মতো থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গর্ভপাত মাতৃত্বজনিত একটি ঘটনা হলেও তা যদি অস্বাভাবিকভাবে হয় তখন এটাকে অনেকে ভিন্ন চোখে দেখে। আর এই সুযোগে বিভিন্ন ক্লিনিক রোগীকে তাদের অর্থ বানানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। একারণে দূরে অবস্থান করলেও ছেলে মেয়েদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে উঠছে গভীর সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের শেষ পরিনতিতে অবৈধ গর্ভপাতের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ২৬ মিলিয়ন বৈধ ও ২০ মিলিয়ন অবৈধ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৯৭ ভাগ অনিরাপদ গর্ভপাত ঘটে উন্নয়নশীল দেশে। স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা গাটমেচারের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখের বেশি গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। যার বেশির ভাগই অনিরাপদভাবে সংঘঠিত হয়। জনসংখ্যার অনুপাতে যা প্রতি হাজারে ১৮.২ জন।
বাংলাদেশ মানবধিকার নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৭৮ হাজার অবৈধ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। গর্ভপাতের কারণে এর মধ্যে ৮ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করে। অবৈধ এসব গর্ভপাতের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায়। আইসিডিডিআরবি’র কয়েক বছর আগের এক গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১৮টি অবৈধ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে থাকে। এসব নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে। এ সবের মধ্যে ৩.৩ শতাংশ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে বিবাহ-বর্হিভূত সম্পর্কের কারণে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের পেনাল কোডে গর্ভপাত অবৈধ। একারণে চিকিৎসকরা সহজেই গর্ভপাত করাতে রাজী হন না। তবে গর্ভধারিণীর জীবন রক্ষায় গর্ভপাত বৈধ বলে উল্লেখ করা হলেও রয়েছে নানা জটিলতা। প্রকৃত গর্ভধারিণী কোনও জটিল রোগে আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই কেবল বৈধভাবে গর্ভপাত ঘটানো সম্ভব। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের মাধ্যমে গর্ভধারণ আইনের চোখে অপরাধ তো বটেই সামাজিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে গর্ভপাতের ঘটনাগুলো অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নারীরা প্রেমিক বা বন্ধুদের কাউকে স্বামী সাজিয়ে মেটার্নিটি হাসপাতালে যায়।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বেশি অবৈধ গর্ভপাত ঘটানো হয় সরকারি মাতৃসদনগুলোতে। মাতৃসদনের অভিজ্ঞ আয়ারা নিজেরাই অবৈধ গর্ভপাত ঘটিয়ে থাকেন। আজিমপুরের সরকারি মাতৃসদন এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। এছাড়া বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত মাতৃ ক্লিনিক ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রাইভেট ক্লিনিকেও অবৈধ গর্ভপাত করানো হয়। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি মাতৃসদনগুলোতে দেখা গেছে, প্রতিটি মাতৃসদনে প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ টি গর্ভপাত সংক্রান্ত রোগী আসছে। পরিচয় গোপন করে অনেকে তিন মাসের বেশি বয়সের ভ্রূণও গর্ভপাত ঘটাচ্ছে।
প্রসূতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভপাতের বিষয়টি কিছুটা স্পর্শকাতর। এ সময় পরিবেশ যথেষ্ট স্বাস্থ্য সম্মত না থাকলে সেখান থেকে নানা রকম ইনফেকশন হতে পারে। তা ছাড়া একাধিকবার গর্ভপাতের ফলে ভবিষ্যতে সন্তান ধারণ করতেও জটিলতা দেখা দেয়।-মানবজমিন

নিউজবাংলা/একে