নিউজবাংলা: মঙ্গলবার, ৩০জুন:

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঈদ কিংবা পূজা যে কোন পার্বণ্যেই বাঙালী নারীর চাই নতুন শাড়ি। আর তা যদি হয় টাঙ্গাইলের তাঁতে বুনানো শাড়ি তাহলেতো কথাই নেই। বলা যেতে পারে, টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির প্রতি রয়েছে নারীর আলাদা টান। বাহারি রঙ আর আধুনিক কারুকার্যের টাঙ্গাইল শাড়ি সহজেই নারীর মন আকর্ষণ করে। এজন্য টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি এখন দেশী বাজারের চাহিদা পুরণ করে ভারতের বাজারেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পবিত্র ঈদ-উল ফিতরকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র আর নতুনত্ব। শাড়ীর পাশাপাশি এবার টাঙ্গাইলের তাঁতে তৈরী হচ্ছে তরুনীদের রুচীশীল থ্রীপিচ। সারাদেশে নারীর এই চাহিদা পূরণ করতে এখন ভীষন ব্যস্ত সময় কাটছে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী। ফলে তাঁতপল্লীতে এখন উৎসবমূখরতা বিরাজ করছে। তাঁত শিল্পী লাভলু মিয়া জানান, উৎপাদনের ভিত্তিতে সাপ্তাহিক বিল আসে। এছাড়া ঈদের জন্য শাড়ির চাহিদা বেশি। সেক্ষেত্রে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে।

টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে খ্যাত দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলুয়া, দেওজান, নলশোঁধা, বিষ্ণুপুর ও গোপালপুর,

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ধুলটিয়া, বাজিতপুর, সুরুজ,বামনকুশিয়া, ঘারিন্দা, গোসাই জোয়াইর, তারটিয়া, এনায়েতপুর, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, কাগমারী,কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, ছাতিহাটি, আইসরা, রতনগঞ্জ কোবডোরাতে এখন সরগরম। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কর্মব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন এ অঞ্চলের তাঁত শিল্পীরা। জেলার প্রায় ৬৫ হাজার তাঁতে কমপক্ষে দেড় লাখ শ্রমিক দিন-রাত পরিশ্রম করছে ঈদ মার্কেটের চাহিদা মেটাতে। রমজান শুরুর অনেক আগ থেকেই প্রিয়জনের জন্যে পছন্দের শাড়ি কেনার পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারী শাড়ি ব্যবসায়ীরা ভীড় করছেন দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলের তাঁতপল্লীতে। নারীরাও টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীতে এসে পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি কিনছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শাড়ি কিনতে আসা শিরিন পারভীন জানান, টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি দুর্বলতা আগে থেকে। তাই প্রকৃত টাঙ্গাইল শাড়ি কেনার জন্য তাঁতল্লীতে আসা হয়েছে।

তাঁতপল্লী ঘুরে দেখা গেছে,তাঁত শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। দিনরাত কাজ করার পরও চাহিদা অনুযায়ী শাড়ি সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁতীদের। একসময় টাঙ্গাইলের তাঁতে শুধু সাধারণ মানের শাড়ি তৈরি হতো। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমানে বাহারি ডিজাইন ও আধুনিক কারুকার্যের শাড়ি তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলে। যা নরীদের মন সহজেই আকর্ষন করে। দেখতে পছন্দনীয়,পরনেও আরামদায়ক। মাপে ১৪ হাত এবং নরম মোলায়েম এবং পরতে আরাম। এছাড়া সময় ও চাহিদার সাথে তাল রেখে দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ির আকর্ষণ ও নকশার নতুননত্ত। ঈদের মার্কেটে এবার যোগ হয়েছে সফট সিল্ক, জামদানি, সুতি, ধানসিঁড়ি, আনারকলি, গ্যাস সিল্ক, একতারি, দোতারি নতুন ডিজাইন। তবে এবারের ঈদে সারাদেশে রমনিদের নজর কেড়েছে টাঙ্গাইলের জামদানি। দেশের মার্কেট গুলোতে ব্যাপকভাবে বেচাকেনা হচ্ছে এ শাড়ী। যার ফলে মহাজনদের চাহিদা অনুযায়ী তাঁতের তৈরি জামদানি শাড়ী সরবরাহ করতে তাদের চোখে ঘুম নেই। তাঁতের জামদানি শাড়ি তৈরি করতে হাতের কাজ করা হয় খুব দরদ দিয়ে,গভীর মনোযোগের সাথে অত্যন্ত সুক্ষèভাবে। পুরুষের কাজ তাঁতে শাড়ি বানানো আর চরকা কাটা ও তানা পারির কাজে সহযোগিতা করে পরিবারের নারীরা। তাঁতিরা রঙ মিশিয়ে শাড়ির জমিনে শিল্প সম্মতভাবে তাঁত মেশিনের মাধ্যমে নানা ডিজাইন করে বা নকশা তৈরি করে। নকশা, বুনন, ও রঙয়ের ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্রতা। এসব শাড়ি ২শ,৫০টাকা থেকে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

টাঙ্গাইল শাড়ি এখন নিুবিত্তের সীমানা পেরিয়ে উচ্চবিত্ত ও ফ্যাশনসচেতন নারীদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। দেশের পাশাপাশি ভারতসহ অন্যান্য দেশেও দ্রুত টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টাঙ্গাইল শাড়ির ডিজাইনে বৈচিত্র থাকায় ভারতে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান ভারত থেকে আসা ব্যবসায়ী হরিপদ বসাক। ঈদ সামনে রেখে জমে উঠেছে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির বাজার। টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির বৈচিত্র আর নতুনত্ব ঈদকে উপলক্ষ করে আরও একধাপ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এসব শাড়ি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশ এবং দেশের বাইরেও।

টাঙ্গাইল শাড়ি প্রস্তুতকারক এলাকা পাথরাইলে নিজস্ব সোরুম, জেলা শহরের সমবায়, খান প্লাজা, হিরা সুপার মার্কেট, টাঙ্গাইল প্লাজাসহ দেশের অন্যতম শাড়ি হাট করটিয়ায় জমে উঠেছে শাড়ি বেচা কেনা। প্রতিদিনই লক্ষ করা যায় উপচে পড়া ভীড়।

সিলেট থেকে আসা শাড়ি ব্যবসায়ি নিহার কুমার রায় বলেন, ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতেই পতিনিয়ত টাঙ্গাইল শাড়ি সংগ্রহের জন্য তাঁতপল্লীতে আসতে হয়।

তবে অভিযোগ রয়েছে, তাঁতপল্লী থেকে শুরু করে টাঙ্গাইল শাড়ির বিভিন্ন শো-রুমগুলোতে ভারতীয় শাড়ির অনুপ্রবেশ হওয়ায় ক্রেতারা অনেক সময়ই বিপাকে পড়ছে।

শাড়ি ব্যবসায়ী নীল কোমল বসাক জানান, দূরদূরান্ত থেকে আমাদের নিয়মিত ক্রেতারা আসছেন। হরতাল অবরোধ না থাকায় শাড়ির মূল্য স্বাভাবিক রয়েছে। টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি তার নিজস্ব স্বকীয়তায় ক্রেতাদের মন জয় করে এখন বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছে।

তবে সাধারণ তাঁতীদের অভিযোগ, সরকার এ শিল্পের উন্নয়নে কোন নজর দিচ্ছেনা। সুঁতার দাম দিন দিন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যার ফলে এ ব্যবসা চলে যাচ্ছে সাধারণ তাঁতিদের কাছ থেকে বিত্তবানদের কাছে। গত ১০ বছরে প্রায় ৪৫ শতাংশ তাঁত বন্ধ হয়েছে। আর ঈদের পর বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে আরো তাঁত কারখানা। অধিকাংশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত তাঁতিরা কাপড় বুনন ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়ছে। ভারতীয় শাড়ি আমদানি বন্ধ করে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের প্রয়োনীয় পদক্ষেপ কামনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নিউজবাংলা/একে