নিউজবাংলা: ৪জুলাই, শনিবার:

ঢাকা: স্বাভাবিক সময়ের মধ্যে ফৌজদারি মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়েছে দেশে এমন নজির নেই। রাজশাহীর জেলা জজ আদালতের ৪৪৫টি মামলার বিচার কার্যক্রমের উপর অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে ২০৭টিতে তদন্ত কর্মকর্তার গড় হাজির, ৫৫টিতে মেডিক্যাল অফিসার এবং ৩৫টিতে এজাহার দায়েরকারী এবং ১৪৮টিতে সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে বিচার বিলম্বের ঘটনা ঘটেছে। এই মামলাগুলো দায়ের হয়েছিলো ২০১০ সালের আগে; কিন্তু এর একটিও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

প্রতিবেদন ইত্তেফাক।

 

এ চিত্র শুধু রাজশাহীর নয়, সারা দেশের আদালতগুলোতে। আইন কমিশনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কোন কোন মামলায় সাক্ষী হাজির করার জন্য আদালত ৩০ বারের বেশি সমন জারি করেছে; কিন্তু পুলিশ সাক্ষী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেনি। অপরাধ সংঘটনে দীর্ঘ বছর পর জবানবন্দি দিতে এসে অনেক সাক্ষী ঘটনার স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। কিছু মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। সাক্ষীর অনুপস্থিতি ছাড়াও তদন্তে ধীরগতির কারণে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।

সম্প্রতি আইন কমিশন ফৌজদারি মামলা বিলম্বের কারণ চিহ্নিত করতে রাজশাহীর জেলা জজ, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, বিশেষ ট্রাইব্যুনালসহ ফৌজদারি আদালতের বিচারাধীন মামলার বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়। এ নিয়ে কমিশন আদালতসূমহের বিচারকদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফৌজদারি বিচার প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় যথাযথ সাক্ষী উপস্থাপন ও সাক্ষ্য গ্রহণ সর্বাপেক্ষা তাত্পর্যপূর্ণ। ফৌজদারি মামলার বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার প্রধান কারণ এসব মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরে আদালতে সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তদন্তকারী কর্মকর্তার অনুপস্থিতির কারণে মামলার বিচার নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এর পরেই রয়েছে জব্দকৃত আলামত প্রদর্শন করার জন্য জব্দ তালিকার সাক্ষী ও মেডিক্যাল অফিসারের অনুপস্থিতি। এছাড়া কখনো কখনো অভিযোগের সমর্থনে অভিযোগকারীর সাক্ষ্য প্রদান করতে না আসার কারণে ফৌজদারি মামলাসমূহের বিচার বিলম্বিত হয়ে থাকে। বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে সাক্ষীর উপস্থিতি আরো কমতে থাকে।

রাজশাহী জাজশিপের ৪৪৫টি বিলম্বিত ফৌজদারি মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, ২০৭টি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (পুলিশ), ৫৫টিতে মেডিক্যাল অফিসার, ৩৫টিতে মূল অভিযোগকারী এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী অনুপস্থিত রয়েছেন ১৪৮টি মামলাতে। এর মধ্যে রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিলম্বিত মামলার সংখ্যা ১৭৯টি। এর মধ্যে ৮৮টি মামলা তদন্ত কর্মকর্তা, ৪০টিতে মেডিক্যাল অফিসার এবং ৬৫টি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৩-এ ১৬৩টি বিলম্বিত মামলার মধ্যে ৮৯টি মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা, ১৪টিতে মেডিক্যাল অফিসার, ১৫টিতে মূল অভিযোগকারী ও ৪৮টিতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সনম পাওয়ার পরেও আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হননি।

রাজশাহীর যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৬-এর ৯০টি মামলার মধ্যে ৩০টিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা, ১টিতে মেডিক্যাল অফিসার, ২০টিতে মূল অভিযোগকারী ৩৫টিতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ার কারণে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না এসব মামলা। শুধু রাজশাহী জাজশিপেই নয় এ চিত্র দেশের বিভিন্ন ফৌজদারি আদালতেই বিদ্যমান।

কমিশনের এ সংক্রান্ত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ফৌজদারি মামলার বিচার দেওয়ানি মামলার তুলনায় অপেক্ষাকৃত অধিকতর বিস্তৃত প্রক্রিয়া। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় বিচার প্রশাসন সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আদালতসমূহের পাশাপাশি দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষ করে তদন্তকারী সংস্থাসমূহের সমন্বিত ও গঠনমূলক একটি মিথষ্ক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত ফৌজদারি মামলার তদন্ত, অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ ও সংরক্ষণ, আদালতে ফৌজদারি মামলাসমূহের সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, আদালতে তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের নিম্ন আদালতসমূহ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল।

কমিশনের অভিমতে বলা হয়, আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে আদালত থেকে ইস্যুকৃত ওয়ারেন্ট যথাযথভাবে তামিল না হলে কিংবা তামিল করা অসম্ভব হলে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে সে সংক্রান্ত কোন প্রতিবেদন প্রায়শই ওয়ারেন্টে উল্লেখকৃত তারিখের আগে আদালতে পাঠানো হয় না। যার ফলে একই সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একাধিক ওয়ারেন্ট অকার্যকর অবস্থায় থানায় জমে থাকে। অথচ ঐ ওয়ারেন্ট কিংবা যে সাক্ষীর প্রতি ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে তার উপস্থিতির সম্ভাব্যতার বিষয়ে আদালত ওয়াকিবহাল থাকে না।

এতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা বৃদ্ধি পায় এবং আদালতের পক্ষে ঐ সাক্ষীকে বাদ দিয়ে মামলার কার্যক্রম অগ্রসর করা দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগও উপযুক্ত সাক্ষ্যের অভাবে আদালতে প্রমাণিত হয় না। অভিমতে আরো বলা হয়, নারাজি দরখাস্ত শুনানিতে সময়ক্ষেপণ, উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশ, রিভিশন মামলায় ব্যবহারের জন্য নিম্ন আদালতের নথি উচ্চ আদালতে তলব ও আইনজীবীদের সময় প্রার্থনার কারণে বিচার বিলম্বিত হয়ে থাকে। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রত্যেক জেলায় পৃথক ও স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা গঠন করা হলে তদন্তে যে ধীরগতি তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। এছাড়া স্থগিতাদেশ ও রিভিশন মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন বলেও মনে করে কমিশন।

 

 

নিউজবাংলা/একে