নিউজবাংলা: ২৯জুলাই : বুধবার:

বিশেষ প্রতিনিধি, টাঙ্গাইল:

আমানুর রহমান খান রানা এমপি ও পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি আদালতে শেষদিনেও হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করেননি। হাইকোর্টের নির্দেশে গতকাল মঙ্গলবার নিম্ন আদালতে তাদের আত্মসমর্পণের শেষ দিন ধার্য ছিল।

পুলিশ-র‌্যাব ও প্রতিপক্ষের অসংখ্য নেতাকর্মীর উপস্থিতির কারনে পরিবেশ না থাকায় তারা আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেননি।

একাধিক আইনজীবী এ অভিমত ব্যাক্ত করে বলেন, আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় আদালতের আদেশ অমান্যের অভিযোগে তাদের ক্ষতি হতে পারে।তাদের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী আ’লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে বলে ডিবি পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।

গত ১৪ জুলাই হাইকোর্টের নির্দেশে দুইসপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে আমানুর রহমান খান রানা এমপি ও টাঙ্গাইলের পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তির আত্মসমর্পণের কথা ছিল। তারা আদালতে আত্মসমর্পন করবেন এমন গুঞ্জনও ছিল।

তাদের আত্মসমর্পণে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ‘নির্যাতিত আওয়ামী পরিবার’ ব্যানারে আ’লীগের একাংশের কর্মসুচি ও পুলিশ-র‌্যাবের পাশাপাশি তাদের সতর্ক পাহারা। আদালত চত্বরে গত কয়েকদিনের মত গতকাল মঙ্গলবারও পুলিশ-র‌্যাবের কড়া পাহারার পাশাপাশি খান পরিবারের প্রতিপক্ষের তীক্ষ্ণ নজরদারী অব্যাহত ছিল। প্রতিপক্ষরা আদালত চত্বরে গতকাল মিছিল সমাবেশ করে খানপরিবারের চার ভাইয়ের ফাঁসি দাবী করে। সবকিছু মিলিয়ে আদালত চত্বরে ছিল চাপা উত্তেজনা।

জানা যায়, টাঙ্গাইলে এক সময়ের সিদ্দিকী পরিবার বিরোধী আ’লীগের প্রভাবশালী নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদের রাজনৈতিক অভিভাবকত্বে খান পরিবার আওয়ামী রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। তাদেরকে ঘিরেই প্রসারিত হচ্ছিল নেতাকর্মীদের কর্মকান্ড। অনেকেই তাদের সুবিধাভোগে রাতদিন তাদের কাছে ধর্ণা দিতে থাকেন। প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে একচেটিয়া প্রাধাণ্য। অন্যকোন নেতা নিয়মিত দলীয় কার্যালয়ে না গেলেও ব্যাতিক্রম ছিলেন ফারুক আহমেদ। তিনি জেলা কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। প্রতিদিনই তিনি দলীয় কার্যালয়ে বসে থাকতেন। এতে অনেক শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দলীয় কার্যালয়মুখী হতেননা। দলীয় কর্মকান্ডও একমুখি হয়ে পড়ে। দলের সিনিয়র নেতাদের অনুপস্থিতিতে ফারুক আহমেদের অভিভাবকত্বেই খান পরিবার টাঙ্গাইলের আওয়ামী রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। সহিদুর রহমান খান মুক্তি টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের আধিপত্যের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বড়ভাই আমানুর রহমান খান রানা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল-৩(ঘাটাইল) আসনের উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি পরবর্তীতে আ’লীগের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। আরেক ভাই জাহিদুর রহমান খান কাকন টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি,বাস মালিক সমিতির সভাপতি ও জেলা ব্যবসায়ী ঐক্যজোটের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছোট ভাই সানিয়াত খান বাপ্পা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি, বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের (সাকসু) ভিপি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারন সম্পাদক হন। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিতে নেতাকর্মীরাও তাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারী রাতে প্রভাবশালী নেতা ফারুক আহমেদ নিহত হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে কলেজপাড়ার বাসভবনের কাছ থেকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর তিনদিন পর তার স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে টাঙ্গাইল মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। মামলার তদন্ত কার্যক্রম মডেল থানা পুলিশের কাছ থেকে গোয়েন্দা পুলিশের উপর ন্যাস্ত হয়। দীর্ঘ ২০ মাস অতিক্রমের পর ডিবি পুলিশ রাজা ও মোহাম্মদ আলী নামের দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ফারুক হত্যায় চারভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেয় বলে ডিবি পুলিশ সুত্র জানায়। এরপর থেকেই আওয়ামী রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। চার ভাই আত্মগোপন করেন। তাদের সুবিধাভোগিসহ অনুসারীরাও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

এমনি অবস্থায় চার ভাইয়ের ফাঁসির দাবীতে ‘নির্যাতিত আওয়ামী পরিবার’ এর ব্যানারে কর্মসুচি চলতে থাকে। ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ,জেলা আ’লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম,সাবেক কমিশনার সাইফুজ্জামান খান সোহেল,জার্মান আ’লীগ নেতা তানভীর আহমেদ ছোটমনি, জেলা তাঁতীলীগের আহ্বায়ক সোলায়মান হাসানের নেতৃত্বে আ’লীগ ও অঙ্গসংগঠনের একাংশের নেতাকর্মীরা ফারুক হত্যার বিচারের দাবীতে প্রতিবাদসহ বিভিন্ন কর্মসুচি পালন করতে থাকে।
গত ১২ জুলাই হাইকোর্টের দুইসদস্য বিশিষ্ট বিচারকের প্যানেল খান পরিবারের দুইভাই আমানুর রহমান খান রানা এমপি ও পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তির জামিন আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৪ জুলাই দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দেন।

১৬ জুলাই রাতে মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি তার কলেজপাড়ার বাসভবনে ফিরে আসার খবরে টাঙ্গাইলের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শুক্রবার সকালে দলীয় কার্যালয়ে তার অনুসারীরা তাকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতির সময় প্রতিপক্ষরা তাদের উপর হামলা চালায়। এতে সময় টিভির ক্যামেরাপার্সন রাশেদসহ কয়েকজন আহত হন। প্রতিপক্ষরা মুক্তির কলেজপাড়ার বাসভবনের সামনে গিয়ে ঢিল ছুঁড়ে। এসময় মুক্তির অনুসারীরাও পাল্টা ঢিল ছুঁড়ে । পরে পুলিশ ও র‌্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এসময় ২৭ জনকে আটক করা হয়।
রবিবার মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি পৌরসভায় এসে কাজে যোগদান করতে পারেন এমন ধারনায় তাকে প্রতিহত করতে স্থানীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থান কর্মসুচিসহ বিক্ষোভ মিছিল অব্যাহত রাখে ‘নির্যাতিত আওয়ামী পরিবার’ এর ব্যানারে আ’লীগের একাংশ। খান পরিবারের অনুসারীরা এসময় মাঠে না থাকলেও শহরের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে। এমনি পরিস্থিতিতে মেয়র মুক্তি বাসা থেকে তার যোগদানপত্র পৌরসভা কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন বলে সুত্রে জানা গেছে। পরে মুক্তি আবার আত্মগোপনে চলে যান।

উল্লেখ্য,২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুলাই রাতে প্রভাবশালী আ’লীগ নেতা ফারুক আহমেদকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তার কলেজপাড়ার বাসার কাছ থেকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যাবিশিস্ট হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিউজবাংলা/একে