নিউজবাংলা: ২৯জুলাই : বুধবার:
ঢাকা : পৃথিবী বিনির্মাণের পর পৃথিবীর সৌন্দর্যকে রঙ তুলির মাধুর্যে যে কয়জন আঁকিয়ে তুলে ধরতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে ভ্যাঁস ভ্যান গঘ অন্যতম।

জীবদ্দশায় মূল্যায়িত হননি, তিনি যতোদিন বেঁচে ছিলেন তাকে নিয়ে নামমাত্র লেখা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। তাও তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগে। আবার তারই আঁকা প্রত্যেকটা ছবির ফ্রেম এখন ডাক তুলে লাখ লাখ ডলার আর পাউন্ডে বিক্রি হয়, অথচ বেঁচে থাকতে তার মাত্র একটি চিত্র খুব সামান্য মূল্যে বিক্রি হয়েছে।
মহান এই চিত্রকর বারবার রূপ আর সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছেন, কিন্তু প্রায় সবাই তাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে। যখনই যাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়াতে চেয়েছেন, সে-ই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন; শুধু নিজের ছোট ভাই থিও ছাড়া। কারণ তিনিই একমাত্র বিশ্বাস করতেন যে একদিন ভ্যাস ভ্যান গঘ বড় আঁকিয়ে হিসেবে নাম করবেন; আর এইজন্য ভ্যান গঘের মৃত্যুর আগেরদিন পর্যন্ত তার খরচ চালিয়ে গেছেন ভাই থিও। এই লেখা মহান চিত্রকর ভ্যান গঘের জীবন সংগ্রাম কিংবা তার উদভ্রান্ত জীবনের গল্প নয়, স্রেফ তার জীবনে বিভিন্ন নারীর প্রেমের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, এই লেখাটি তার মৃত্যুদিবস উপলক্ষে মোবাশ্বের আলীর লেখা ‘বিশ্ব সাহিত্য’ থেকে অনুপ্রাণিত। ১৯৮০ সালের ২৯ জুলাই এই মহান শিল্পীর মৃত্যু হয়।
ভ্যান গঘ, জন্মের পর থেকেই একা একা বড় হয়েছেন। যদিও ছিলেন মা-বাবার খুব আদুরে সন্তান। কারণ তার আগে আরো একজন ভাই হয়েছিল তার, কিন্তু জন্মের কিছুদিন পরেই মারা যায়। বাবা মা তার নাম রেখেছিলেন ‘ভ্যাঁস’। ভ্যান গঘ জন্মের পর বাবা-মা তার নামও রাখেন মৃত বড় ছেলে ভ্যাঁসের নামেই। একটু বোধশক্তি হওয়ার পর একদিন কবরস্থানে গিয়ে দেখেন ‘ভ্যাঁস’ লেখা একজনের কবর। নিজের নামও ভ্যাঁস, আবার একজন কবরে শুয়ে আছেন তার নামও ভ্যাঁস। এ বিষয়টি ছোট্ট গঘকে ভাবিত করে তোলে। যে বয়সে মাঠে গিয়ে খেলা করার বয়স, সে বয়সে গঘ প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘুরে বেড়ান, একা একা। প্রকৃতির এমন সম্মোহনী সৌন্দর্য তার ভালো লাগে। কিন্তু এভাবেতো আর জীবন চলে না! রিলিজিয়ন আর্টের হয়ে চাকরি নিয়ে তরুণ বয়সেই ইংল্যান্ডে যান গঘ। সেখানে গিয়েও প্রকৃতির সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ান তিনি। অফিস কোর্ট-কাচারির দেয়াল তার দম বন্ধ হয়ে আসে, শুধু তাকে টেমস নদীর সৌন্দর্য, আর সেই নদীর পাড়ের মানুষকে দেখতে ভালো লাগে তার।
এরমধ্যে প্রথমবার প্রেমে পড়েন উরসুলা নামের এক ব্রিটিশ মেয়ের। কয়দিন উরসুলার সাথে ঘুরোঘুরিও করেন। ফলত চাকরি চলে যায় তার। ফের মা-বাবার কাছে ফিরে আসতে হয় তাকে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে আসার জন্য মন উদগ্রীব করে তার, মন শুধু দেখতে চায় উরসুলাকে। কিন্তু বাবা চান ছেলেকে পাদ্রি বানাতে, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। কিন্তু এরমধ্যে দুই বছরের ছোট ভাই থিওর সাহায্যে ইংল্যান্ড আসেন পড়ালেখা করতে, যদিও মনে মনে থাকে উরসুলার সাথে দেখা করার প্রপঞ্চনা। কিন্তু ইংল্যান্ডে এসেই মোহ ভাঙে তার, কারণ সেখানে এসে দেখেন আরেক পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়ায় উরসুলা। মানতে না পেরে চলে আসেন হল্যান্ডের (বর্তমান নেদারল্যান্ডস) হেগে, বাবা মায়ের কাছে। এবার তিনি ধর্মীয় শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে বেলজিয়ামের অদূরবর্তী এক গ্রামের কয়লা খনিতে যান। কিন্তু ধর্ম প্রচার আর হয়ে ওঠে না। কয়লা খনিতে শ্রমিকের অমানবিক জীবন দেখে আঁৎকে ওঠে গঘের মন।
ঈশ্বর এতো দয়াহীন কী করে হন, এটা তিনি ভাবেন কয়লা শ্রমিকদের দেখে। ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে এসে ঈশ্বরে বিশ্বাস উবে যায় গঘের। মানব কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করার প্রয়াস খোঁজেন। আর সেখানেই তিনি মনে প্রাণে চিত্রকর হওয়ার বাসনা খুঁজে পান। কয়লা খনি, শ্রমিকের মুখ, তাদের জীবন, জীবনের কান্না সবকিছু তিনি ভাইয়ের পাঠানো টাকায় কেনা রঙ তুলিতে ক্যানভাসে তুলে ধরেন। সেখানে কয়লা শ্রমিকদের সাথে থাকতে থাকতে এক সময় দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েন গঘ।
ছোট ভাই এসে তাকে আবার বাড়ি নিয়ে যায়। বাড়ি গিয়ে দেখেন তার খালাতো বোন ‘কি’। কি’র সৌন্দর্যে আবার রোমাঞ্চিত হন তিনি; কিন্তু কি’ওতো বিবাহিত, ফলে ভালো লাগলেও তাকে আর বলা হয়ে ওঠে না। একসময় কি’র স্বামী মারা গেলে তার রূপ, সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েন গঘ, এবং তা প্রকাশ করেন। কিন্তু কেউ মেনে নেয়নি। মা-বাবাসহ আত্মীয় স্বজনরা ধর্মের দোহাই তোলেন এই বলে যে, খালাতো বোনের সাথে সম্পর্ক করতে নেই, এটাতো রক্তেরই সম্পর্ক। কি’ও প্রচন্ড ঘৃণা করতে থাকেন গঘকে। ফলে তা আর হয়ে ওঠে না। তিনি চলে যান তার পুরনো জায়গা বোরিনাজে। কিন্তু সেখানে গিয়ে একাকিত্ব আরো পেয়ে বসে তার। কি’র সাথে দেখা করতে উঠে পড়ে লাগেন তিনি। কি থাকে আমস্টারডামে, আর সে কতোদূরে! তাছাড়া এতোদূরে যাওয়ার পয়সাও নেই তার। মনের কষ্টে আবার চিঠি লিখেন ছোট ভাই থিওকে। থিও যথারীতি টাকা পাঠায়, আর এই টাকা নিয়েই কি’কে দেখতে ছুট দেয় গঘ। কিন্তু কি’র সাথে দেখা করতে পথ আগলে দাঁড়ায় তার বাবা, মানে গঘের খালু মশায়। পাগলের মতো আচরণ শুরু করে গঘ। একসময় ঘরে মোমের জ্বলন্ত প্রদীপে মেলে ধরেন তার হাত, এবং খালুকে বলেন কি’র সাথে ততক্ষণ কথা বলবে যতক্ষণ সে আগুনে তার হাত ধরে রাখতে পারবে। গঘের এমন পাগলামি আচরণে খালু বিস্মিত হয়, তাকে ঝাপটে ধরে আগুন থেকে রক্ষা করে এবং বুঝিয়ে শুনিয়ে বলে যে ‘কি’ সত্যিই তাকে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে। অতঃপর বাধ্য হয়েই পুরা হাত আর ক্ষতাক্ত হৃদয় নিয়ে ফিরে আসেন ভ্যান গঘ।
এবার বাস করতে থাকেন হেগে। ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করে থাকেন, আর ভাইয়ের পাঠানো পয়সায় এঁকে বেড়ান। কিন্তু দু’দুটো প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার পর ভ্যান গঘ সৃষ্টির উন্মাদনায় একেবারে উঠে পড়ে লাগেন। রঙ, পেন্সিল আর ক্যানভাস নিয়ে ছোট্ট একটি স্টুডিও-ও ভাড়া করে ফেলেন। খেয়ে না খেয়ে সারাদিন আঁকাআঁকি নিয়ে পড়ে থাকেন। নিয়মিত ভাইয়ের থেকে টাকা আসে, আর টাকা হাতে পেলেই চলে যান সামনের একটি ক্যাফেতে। সেখানেই হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় ক্রিস্তিনের সাথে। ক্রিস্তিন মূলত একজন দেহপসারিনী, সারাদিন ধোপার কাজ করে আর রাত হলে খদ্দের ধরে। তার আছে পাঁচ সন্তান, কারোরই পিতৃপরিচয় নেই।
ওইরাতেই ভাইয়ের পয়সায় ক্রিস্তিনের খদ্দের হয় ভ্যান গঘ। নারীর শরীরের স্পর্শ আগে না পেলেও ক্রিস্তিনের স্পর্শ তাকে পাগল করে তোলে। ক্রিস্তিনকে জীবনসঙ্গী বানানোর পরিকল্পনা করে গঘ। কেউ মেনে নিক বা না নিক, তাতে তার সামান্য ভ্রুক্ষেপও নেই।
ছোট ভাই থিওকে চিঠিতে বিস্তারিত জানায় সে। ছোট ভাই রাজি হয়, এবং জানায় যে সে টাকা পাঠানো বন্ধ করবে না। আশ্বস্ত হয় গঘ। ক্রিস্তিনের সাথে একসাথে বসবাস করতে থাকেন মনের আনন্দে, যদিও তার পাঁচটি সন্তানকে রেখে আসা হয় ক্রিস্তিনের মায়ের সাথে। নানা মানুষ তাদের উদ্দেশ করে নানান বিদ্রুপাত্মক কথা বলে, কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে মনের সুখে ক্রিস্তিনকে মডেল করে ছবি আঁকতে থাকে। ক্রিস্তিনও তার বিষে ভরা অতীত জীবনকে গঘের সংস্পর্শে এসে বিদায় জানাতে চায়। দেহ বিক্রি তারও ভালো লাগতো না কখনো, কিন্তু তার পেটে যে এখনো অন্যের বাচ্চা! এরও দায়িত্ব নেন স্বয়ং ভ্যান গঘ, ক্যানভাসের সামনে দাঁড় করিয়ে ক্রিস্তিনকে নানারূপে আঁকতে থাকেন তিনি; কখনো ক্রিস্তিন একজন দুঃখী নারীর অবয়ব, আবার কখনো পৃথিবীর সঞ্চারিত প্রাণরূপে তাকে আঁকতে থাকেন গঘ। এভাবেই চলতে থাকে।
বিবাহবহির্ভূত ছেলের সংসার এসে দেখে যান ভ্যান গঘের বাবা, তিনি ধার্মিক মানুষ ফলে গঘের এমন কীর্তি তিনি মেনে নেন না; কিন্তু ছোট ভাই থিওর ভাবি হিসেবে পছন্দ হয় ক্রিস্তিনকে। থিওর বিশ্বাস ছিল, গঘ যাই করুক না কেনো, সে একদিন মস্ত আঁকিয়ে হবে।
সে যাই হোক, ভ্যান গঘের দিন আবার বয়ে যায়।
এক বছর যেতে না যেতেই ক্রিস্তিন অন্যরূপে ধরা দেয়, সে আবার পুরনো অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে থাকে। মদ পান, রাত বিরাতে ঘুরাঘুরি, অন্য পুরুষের সাথে দেহ বিনিময় সবকিছুতে ফের অভ্যস্ত হয় সে। ফলে গঘের সাথে প্রায়ই লেগে যায় তার, এখন আর আগের মতোন গঘের ছবির মডেলও হয় না ক্রিস্তিন। এক সময় এইসব বিষয়ের সাথে পেরে না ওঠে ক্রিস্তিনকে রেখেই বাবা-মার কাছে চলে আসে গঘ।
দীর্ঘদিন পর সে পরিবারের সান্নিধ্যে আসে, যে ছেলেকে পাদ্রি করতে চেয়েছিল বাবা-মা, সেই ছেলে দীর্ঘদিন পর ফিরে এসেছে, তাও মাঝখানে এক বেশ্যার সাথে একবছর কাটিয়ে চিত্রকর হয়ে ফিরে এসেছে! এমন পরিস্থিতিতে গঘের ছোট বোন পর্যন্ত তাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি; তাকে একরকম ঘৃণাই করেছে। তার থেকে দূরে দূরে থেকেছে সবাই। তাতেও গঘের কিছু যায় আসেনি, সবার কাছাকাছি থেকেও সে একাই জীবনযাপনে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। কিন্তু সেখানে ঘটে গেছে জীবনের অন্যরকম এক কাহিনী।
জীবনভর সেই শুধু নারীর প্রেমে পড়েছে, কিন্তু এবার তার প্রেমে পড়েছে মার্গো নামের এক কুমারী মেয়ে। মার্গোর বয়স ত্রিশোর্ধ, অন্যদিকে তারচেয়ে বছর দশেকের ছোট গঘ। তাতেও গঘের কিচ্ছু যায় আসেনি। সে একার জীবনে নিজের মধ্যে এক শক্তি খুঁজে পেয়েছে, এই প্রথম কোনো নারী তাকে ভালোবেসে! আহা! এই সুখ সে কোথায় রাখে! মার্গোকে নিয়ে সে বনে-বাদারে ঘুরে বেড়িয়েছে। বিশাল ক্যানভাসে ছবি এঁকেছে, আর তার পাশে বসে থাকে মার্গো। এক অসাধারণ রোমান্টিকতা খেলে যায় তার মনে।
ছবি এঁকে এতো আনন্দ সে কোনোদিন পায়নি। মার্গোর সাথে প্রেম গাঢ় হতে থাকে গঘের। কিন্তু তাদের এই অবাধ মেলামেশাও সমাজ মেনে নিতে পারে না, পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মার্গোর পরিবার। কারণ মার্গোর পরিবার ছিল অনেক পয়সাওয়ালা, অন্যদিকে গঘ দিন এনে দিন খাওয়া এক ভবঘুরে চিত্রকর। তাছাড়া মার্গোর পরিবার গঘের প্রতি বেশি সন্দেহাবাতিক হয়ে পড়ে এই কারণে যে, তারা ভাবে গঘ গরীব, আর সেই জন্যই তারচেয়ে বেশি বয়সী মার্গোর সাথে অর্থপ্রাপ্তির জন্য প্রেমের অভিনয় করছে।
হৃদয়ের আর্তিকে বোঝার ক্ষমতা কারো হয় না। এমতাবস্থায় গঘকে না পাওয়ার কোনো উপায়ান্তর না দেখে মার্গো আত্মহত্যা করে। আর এরজন্যও দায়ী করা হয় গঘকেই। অতঃপর ফের সেখান থেকেও বিদেয় নেয় গঘ।
এবার শিল্পী হিসেবে গঘের প্রথমবার পরিচয় হয় শিল্প, সাহিত্য আর সভ্যতার নগরী প্যারিসের সাথে। মূলত এখানে তার ভাই থিও-ই তাকে নিয়ে আসে। এখানে এসে এক ভিন্ন জগতের সাথে পরিচয় হয় তার, ভিন্ন মানুষের সাথে পরিচয় হয়, তরুণ শিল্পী, সাহিত্যিক আর দার্শনিকের সাথে পরিচয় ঘটে তার। গগ্যাঁ হয়ে ওঠে তার অন্যতম বন্ধু। দুই বছর প্যারিসে কাটিয়ে তরুণ শিল্পীরা মনে করেন, ছবি আঁকতে চলে যেতে হবে অন্যকোথাও, মানে প্রকৃতির কাছে। একেক বন্ধু একেকদিকে গেলেন। ভাইয়ের টাকায় গঘ ফ্রান্সের দক্ষিণের শহর আর্লসে গেলেন। ভাড়া করলেন একটি হলুদ বাড়ি। হলুদের প্রতি তার একটি টান জন্ম থেকেই বোধহয় ছিল। কারণ তার প্রায় সব ছবিতেই হলুদ রঙের একটা জৌলুস চোখে পড়ে সবার। সেখানে গিয়েই তিনি আঁকলেন তার জীবনের সব অসাধারণ ছবি। কিন্তু সেসব ছবি কখনোই মূল্যায়িত হয়নি, মূল্যও পায়নি। কারণ তার আঁকা সব ছবিই প্যারিসে থাকা ছোট ভাই থিওকে নিয়মিত পাঠাতো সে। কিন্তু কেউ কিনেনি। এমনকি কখনো কোনো চিত্রশালায় প্রদর্শনের জন্যও জায়গা পায়নি। এসব বিষয় নিয়ে ভাবলে মাথা আউলে যায় গঘের। তবে একদিন না একদিন তার আঁকা ছবিগুলো মূল্যায়িত হবে এই আশায় তিনি শুধু এঁকেই যেতেন।
একদিন ভায়ের চিঠিতে জানতে পারলেন বন্ধু গগ্যাঁও (যদিও বয়সে তার বড় ছিল) ছবি বিক্রি করতে না পেরে নিজের ঘরের ভাড়া, এমনকি অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এমন খবর পেয়ে আর্লসের হলুদ বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান গগ্যাঁকেও, যদিও তার খরচ তখনও বহন করেন তার ছোট ভাই থিও। একজনের খরচে দুইজন থাকেন ফ্রান্সের দক্ষিণের শহর আর্লসে। ভাই টাকা পাঠানো মাত্রই সব শেষ হয়ে যায় মদ, পানীয় আর রঙ-তুলি কিনতেই। এরমধ্যে আবার সেখানেই এক যৌনপল্লীতে নিয়মিত এক রূপসীর সান্নিধ্য গ্রহণ করে তারা। ওই রূপসী কখনোই তাদের থেকে টাকা নিত না। কারণ গঘ আগেই বলে উঠতো, আমাদের কাছে টাকা নেই। আর গঘের এমন জবাবে হেসে হেসে প্রায়শই সে বলে উঠতো, আমি টাকা চাই না, তোমার ওই সুন্দর কানটা চাই!
আর্লসে ভালোই চলতে থাকে গঘ ও গগ্যাঁর। কিন্তু ইদানীং প্রায় সময়ই ভ্যান গঘকে একটু ভাবিত দেখায়। তার আচার আচরণেও কিছুটা পরিবর্তন হয়। একটু কিছু হলেই গগ্যাঁর সাথেও ক্ষেপে যায়। একদিন বারে গিয়ে গ্লাসভর্তি মদও ছুঁড়ে মারে গগ্যাঁকে লক্ষ্য করে। একা একা বিড় বিড় করে। সবকিছু কেমন দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। একদিন বড়দিনের আগে এক মহাকাণ্ড করে বসে ভ্যান গঘ। নিজের কান কেটে ওই ষোড়শী রূপসীর উদ্দেশে পার্সেল করে পাঠিয়ে দেয়। এমন কাণ্ডের পর হলুদ বাড়ি রক্তে ভেসে যেতে থাকে। বন্ধু গগ্যাঁ বাড়িতে না থাকলেও পরে এসে তাকে দ্রুত হাসপাতাল নিয়ে যায়। এরপর থেকে বেশিরভাগ সময়ই তাকে মানসিক হাসপাতালে থাকতে হয়। কিছুটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে বটে, কিন্তু চিত্রকর সত্তাটাকে কখনো ভোলেননি।
ডাক্তারকে অনুনয় বিনয় করে পাগলা গারদে থেকে প্রায় সময়ই বেড়িয়ে যেতো ছবি আঁকতে। ডাক্তারও তাকে বাধা দিত না। কারণ, বাধা দিলে সে আরো বেপরোয়া হয়ে যেতো। এমতাবস্থায় একদিন প্যারিস থেকে ভাই চিঠি লিখে যে তার একটি ছবি ও তাকে নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ হয়েছে। তার আঁকা ছবির প্রশংসা করেছে এমন খবরে ব্যাপক উচ্ছ্বসিত হয় গঘ। নতুন উদ্যমে আরো বেশি করে আঁকায় মনোনিবেশ করে। কিন্তু অবসাদ আর মানুষের অবমূল্যায়ন তাকে তাড়িয়ে ফিরেছে বারবার। অনেকবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছে, নিজেকে স্বস্তি দেয়ার কথা ভেবেছে। কিন্তু একদিন ঠিকই ডাক্তারের পকেটে থাকা রিভালবার নিয়ে দৌড়ে চলে যায় বিশাল ক্যানভাসে, যেখানে বসে অসংখ্য ছবি এঁকেছে। পেছন পেছন ডাক্তারও হয়তো দৌড়ায়, কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ২৭ জুলাই গুলিবিদ্ধ হলেও এর দুইদিন পর ২৯ জুলাই নিঃসঙ্গ অবস্থায় ভ্যান গঘ বিদায় নেয় এই নির্মম পৃথিবী থেকে!

নিউজবাংলা/একে