নিউজবাংলা: মঙ্গলবার, ৩০জুন:

ঢাকা : চট্টগ্রাম বন্দরে তেলের আড়ালে তরল কোকেন আমদানির সঙ্গে জড়িত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রকে খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরু করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তদন্ত কমিটি। কোকেনের পরিমাণ নিরূপণ, দাম ও ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয় নিশ্চিত করতে জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছে এনবি আর।

এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গড়া জাতিসংঘের তদন্ত দলও আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশে আসতে পারে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের পাশাপাশি নগর গোয়েন্দা পুলিশও এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত করবে। আজ মামলার নথিপত্র হাতে এলে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শুরু করবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) এসএম তানভীর আরাফাত। সানফ্লাওয়ার তেলের নামে কোকেন আমদানিকারক গোলাম মোস্তফা সোহেলের ৫ দিনের রিমান্ড আবেদনের ওপর আজ শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

তদন্ত শুরু : শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের চার সদস্যের তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক হোসাইন আহমদ। কমিটিকে তরল কোকেন আমদানির সঙ্গে কারা জড়িত, কারা কিভাবে চালানটি পাঠিয়েছে, আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের কারা এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এসব বিষয় তদন্ত করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে কমিটি।

হোসাইন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে, মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কমিটির এক সদস্য জানান, তাদের টিম প্রাথমিকভাবে যে শিপিংলাইনের মাধ্যমে কোকেনের সেই কনটেইনার উরুগুয়ের মন্টেভিডিওর বন্দর থেকে এসেছে সেই কনটেইনারের মালিক কসকো শিপিংলাইন থেকে বেশ কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। সকালে প্রতিষ্ঠানের আগ্রাবাদ অফিস থেকে তা সংগ্রহ করা হয়। ওই কনটেইনার লোডকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কারা ছিল, কনটেইনারে পণ্যের ঘোষণা কি ছিল, আর কারা কারা এ ধরনের পণ্য আমদানি করে থাকে এ রুট দিয়ে- এসব বিষয়সহ কনটেইনারসংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এসব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে চালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পক্ষকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন তারা।

কমিটির ওই সদস্য আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খান জাহান আলী গ্ররুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে কমিটি। খান জাহান আলীর নামেই এ চালান আনা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত যেসব ব্যক্তি ওই চালান খালাস ও অন্য কোনো দেশে পাঠানোর জন্য তৎপরতা চালিয়েছেন তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সর্বপ্রথম ধরা পড়া এ চালান আমদানির সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের সদস্যরা জড়িত। তাই তদন্ত টিম ১০ দিনের মধ্যে তাদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

কসকো শিপিংলাইনের বক্তব্য : ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর খন্দকার ছিরাজ উদ্দিন আহমেদ সোমবার বলেন, চালানটি আটক হওয়ার পর মৌখিকভাবে ইতিপূর্বে বিভিন্ন তথ্য নেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। সর্বশেষ চিঠি দিয়েও বেশ কিছু কাগজপত্র চাওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- কোন বন্দর থেকে কনটেইনারটি এসেছে, কারা এটি লোড করেছে, এ চালানের ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট কারা ছিল ইত্যাদি। সকালে তদন্ত কমিটির সদস্যদের চাহিদামতো কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তারা বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর থকে মাসে কমপক্ষে পণ্যভর্তি চার হাজার কনটেইনার নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম বন্দরে। কোন দেশের বন্দর থেকে কি লোড করা হচ্ছে বা কোন কনটেইনারে কি আছে তা তাদের পক্ষে জানা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ কনটেইনারে কি আছে কারা লোড দিয়েছে তা আমদানির কাগজপত্রে উল্লেখ থাকে। বন্দরে আসার পর সংশ্লিষ্ট পণ্যের বন্দর ও কাস্টমসের ডিউটি পেমেন্ট করার পর ডেলিভারির জন্য কাগজপত্র জমা দেয়া হলে তারা কনটেইনার ডেলিভারির ছাড়পত্র দেন। তিনি এও আশংকা করেন, এটি আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের কাজ। দেশীয় তদন্তে এর কূল-কিনারা পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ বিদেশের বন্দরে কারা কিভাবে এসব পণ্য লোড করেছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা ততটা সহজ হবে না।

যেভাবে চালানটি আসে : বলিভিয়া থেকে চালানটি উরুগুয়ের মন্টেভিডিও বন্দরে যায়। সেখান থেকে চালানটি আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। এ পণ্য পরিবহনের মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও) হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিপিংলাইন কোম্পানি কসকো শিপিংলাইন। অর্থাৎ তাদের মালিকানাধীন কনটেইনারে করেই চালানটি পাঠানো হয়। এমভি থর স্ট্রিজ নামের জাহাজে চালানটি মন্টেভিডিও থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এ জাহাজের এ দেশী এজেন্ট প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনাল লাইন (পিআইএল)। এটি এইচআরসি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। বন্দরের সিসিটি ইয়ার্ডে কনটেনারটি পড়েছিল প্রায় ১ মাস। এটি রফতানি করে বলিভিয়ার শহর সান্তাক্রুজ এলাকার ইএল ভাইবেন এসআরএল নামে এক প্রতিষ্ঠান। মন্টেভিডিও বন্দর থেকে ফ্রেইট ফরোওয়ার্ডিং এজেন্ট সাউথ ফ্রেইট লজিস্টিক চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায়।

স্পট লাইটে যারা : চালান খালাসের চেষ্টা, চালান পাঠানো ও এ নিয়ে কথোপকথন ও মেইল চালাচালির সঙ্গে জড়িত এ পর্যন্ত ৫ জনের নাম এসেছে গোয়েন্দা সংস্থা ও তদন্ত কমিটির হাতে। এরা হচ্ছেন- যুক্তরাজ্যের নাগরিক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বকুল মিয়া, তার মামাতো ভাই ঢাকার বাসিন্দা মোস্তফা কামাল, মোস্তফা কামালের ভাতিজা আতিকুর রহমান, চট্টগ্রামের খানজাহান আলী লিমিটেডের ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেল, তার খালাতো বোনের স্বামী যুক্তরাজ্য প্রবাসী ফজলুল হক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্য থেকে বকুল ঢাকায় তার মামাতো ভাই মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মোস্তফা কামাল এ বিষয়ে যোগাযোগ করেন তার ভাইপো আতিকের সঙ্গে। বকুল চালান খালাসে কাগজপত্র পাঠানোর জন্য তাগাদা দেন।

বকুল জানান, যুক্তরাজ্যে থাকা তার ভারতীয় এক বন্ধু বলিভিয়া থাকেন। চালানটি আসলে তার। বকুল পরে এ চালানটি খালাসের জন্য চট্টগ্রামের গোলাম মোস্তফার সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন আতিক ও মোস্তফা কামালকে। এরা গোলাম মোস্তফা সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাগজপত্র পাঠায় চট্টগ্রামে। চালানটি খালাস করতে না পারায় এরা বন্দর থেকেই তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর চেষ্টা চালান। এসব তথ্যই রয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং পুলিশের কাছে। আর তা নিয়েই তদন্ত দল প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না : তরল কোকেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের নবী মার্কেটের খানজাহান আলী লিমিটিডের নামে পাঠানো হলেও এ প্রতিষ্ঠান চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসার ১ মাসেও খালাসের জন্য কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নিয়োগ করেনি। তারা সানফ্লাওয়ার তেল আমদানির জন্য কোনো এলসিও করেনি ব্যাংকে। যে কোনো বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি করতে হলে আগে ব্যাংকে এলসি করতে হয়।

সূত্র জানায়, মালিকের অজান্তে খানজাহান আলী গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক সোহেলই তার খালাতো বোনের স্বামী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ফজলুল হকের নির্দেশে চালানটি খালাসের চেষ্টা করেন। এদিকে ওই ঘটনায় সোহেল ছাড়াও খানজাহান আলী লিমিটেডের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদকে আসামি করে মামলা করা হয়। নুর মোহাম্মদ বরাবরের মতোই দাবি করে আসছেন তিনি আদৌ জানেন না কে এ চালান পাঠিয়েছে। তার প্রতিষ্ঠান যদি তেলের চালান আমদানি করত তবে অবশ্যই ব্যাংকে এলসি করত, খালাসের জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নিয়োগ করত। তিনি এসব কিছুই করেননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল প্যাড ও সিল ব্যবহার করে আর তেলের আড়ালে কোকেন আমদানির ঘটনায় খানজাহান আলীর চেয়ারম্যানকে আসামি করা হলেও এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে।

আসবে জাতিসংঘের টিম : সানফ্লাওয়ার তেলের এক ড্রামে কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়ার পর এর পরিমাণ নিরূপণ ও ব্যবহার সম্পর্কে অধিকতর নিশ্চিত হওয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জাতিসংঘের সহায়তা কামনা করে এনবি আর। পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের ব্রিটিশ ও আমেরিকান ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একটি টিম আগামী সপ্তাহেই বাংলাদেশ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই বলছে, আমদানিকৃত কোকেনের এ চালানের গন্তব্য বাংলাদেশ ছিল না। বাংলাদেশে কোকেনের মতো উচ্চমূল্যের মাদক ব্যবহার হয় না। কোকেনের এ চালানের উৎস দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া, মেক্সিকো, পেরু। এসব দেশ থেকে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে কোকেনের চালান যায়।

পুলিশের বক্তব্য : কোকেনের চালান আমদানির ঘটনায় বন্দর থানায় দু’জনকে সুনির্দিষ্ট আসামি করে শনিবার মামলা হলেও সোমবার পর্যন্ত তদন্ত শুরু করেনি পুলিশ। তা ছাড়া শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর এ ঘটনার তদন্ত করলেও ওই তদন্তের ভিত্তিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। শুধু পুলিশি তদন্তই পারে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে।

সিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) এসএম তানভীর আরাফাত বলেন, ‘মামলার ডকেট ডিবিতে এলে কাল (আজ মঙ্গলবার) থেকে তদন্ত শুরু করবেন তারা। সোহেলকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবদ করা হবে। এ চালানের সঙ্গে জড়িত হিসেবে প্রাথমিকভাবে যাদেরই নাম এসেছে প্রয়োজনে তাদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর যে তদন্ত করছে ওই তদন্তও তাদের কাজে লাগবে।

 

 

নিউজবাংলা/একে