প্রস্তুত হচ্ছেন জোবাইদা
নিউজবাংলা: রোববার, ২৮ জুন:
খালেদা জিয়া দন্ডিত কিংবা বন্দি হলে বিএনপির ঐক্য ধরে রাখতে তুরুপের তাস হিসেবে জোবাইদার রাজনীতিতে দ্রুত অভিষেক ঘটবে
বিএনপি ভেঙে পরবর্তী নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পাল্টা কৌশলে এগোচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে দলের শীর্ষনেতা খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র নেতারা নির্বাচনে অযোগ্য হলে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে সামনে এগিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আর সেভাবেই প্রস্তুতিও নিচ্ছেন জোবাইদা। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি ভাঙার ও মামলা দিয়ে শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আগামী সপ্তাহে সৌদি আরবে এ নিয়ে কথা বলতে পারেন। সেখানে থাকবেন ডা. জোবাইদা রহমানও।
বিএনপি সূত্রমতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক থাকায় মধ্যবর্তী একটি নির্বাচনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে সে নির্বাচনেও বিজয় সুনিশ্চিত করতে বিএনপিকে বিভক্ত ও শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার ফন্দি আটছেন ক্ষমতাসীনরা। এজন্য বাড়তি সতর্কতা থাকলেও আতঙ্কিত নয় বিএনপির নীতি নির্ধারকরা।
দীর্ঘ আন্দোলনে ব্যর্থতা, বর্তমান বিএনপিকে দিয়ে হবে না_ এমন প্রচারণা, শীর্ষ নেতাদের সাজা হওয়ার আশঙ্কা, শীর্ষ কয়েক নেতার ফোনালাপ ফাঁসসহ বিভিন্ন কারণে সম্প্রতি দলের ভাঙনের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে। এরপরই শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে আলোচনা করেন হাইকমান্ডের সঙ্গে। তবে এই ইস্যুতে তারা উদ্বেগের কোনো ছাপ দেখেননি বিএনপি চেয়ারপারসনের চেহারায়। নেতাদের মতে, ভাঙন নিয়ে চিন্তিত নন বিএনপি চেয়ারপারসন। এ নিয়ে তার আগাম পরিকল্পনা প্রস্তুত করা আছে। এখন দলকে সংগঠিত করার বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য আগামী বছর সুবিধাজনক সময়কে বেছে নিতে পারে সরকার। এই সময়ের আগেই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাচনে অযোগ্য হতে পারেন। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হয়ে পড়লে বিএনপি আরো চাপে পড়বে। ওই অবস্থায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হবেন না। আর সিনিয়র নেতারা মামলায় এমনভাবে জর্জরিত যে, তাদের কারো পক্ষে দলকে সংগঠিত রাখা সম্ভব হবে না। গত আড়াই বছরে সহিংসতার অভিযোগে সারাদেশে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে ১৫ হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে গত পাঁচ মাসে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিএনপির এক হাজার ১০০ নেতাকর্মীর নামে শতাধিক আইনে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ অন্যান্য আইনের মামলায় কমপক্ষে সাড়ে ৬০০ চার্জশিট আদালতে জমা পড়েছে।
বিএনপির আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ১৩, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৭৬, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৭৮, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ১০, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহ ৮, রফিকুল ইসলাম মিয়া ৫, এমকে আনোয়ার ৫, মির্জা আব্বাস ৭৩, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ১১, বিএনপির সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান ৫, শমসের মবিন চৌধুরীর ৪, সেলিমা রহমান ১০, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু ৫, মোসাদ্দেক আলী ফালু ৪, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান ৮৭, বরকতউল্লা বুলু ৫০, সালাহউদ্দিন আহমেদ ২৭, রুহুল কবীর রিজভী ৪৪টি, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী ৪০টি, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ১১০, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব ১৭৮, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ১০০, সাধারণ সম্পাদক মীর শরাফত আলী সপুর বিরুদ্ধে ১০৫, ঢাকা মহানগর যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ কাইয়ুম ৩৮, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের বিরুদ্ধে ১০১টি, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিবের বিরুদ্ধে ৯৮টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলায় বিচার প্রক্রিয়া যতই এগোবে ততই বিএনপি বেকাদায় পড়তে থাকবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ সূত্রমতে, নিজের এবং নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলার বিষয়টি বিবেচনা করে দলকে সংগঠিত রাখার কর্মপন্থা ঠিক করে রেখেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিশেষ করে ১/১১ প্রেক্ষাপটে যখন বিএনপি ভাঙার সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র হয় এরপরই দল সুরক্ষায় করণীয় নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেন বিএনপিপ্রধান। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে হঠাৎ মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়ে যেভাবে সেই সময়ে একটি প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেছিলেন খালেদা জিয়া, ঠিক সেভাবেই পরবর্তীতে কাকে, কখন, কিভাবে কাজে লাগাতে হবে সে বিষয়টিও ঠিক করে রেখেছেন। এছাড়া জিয়া পরিবারের সদস্যদের কখন কি ভূমিকা পালন করতে হবে সেই নির্দেশনাও দিয়ে রেখেছেন। এরপরও সম্প্রতি ভাঙন ইস্যুটি সামনে আসায় দলের পাশাপাশি পারিবারিকভাবেও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা করবেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। ২০ রমজানে পবিত্র ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরব যাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে লন্ডন থেকে সৌদি যাবেন তারেক রহমানও। সেখানে ওমরাহ পালনের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দলকে সংগঠিত করার বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হবে।
এদিকে জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রমতে, চলতি বছরে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাজা দেয়া হতে পারে, এমন ধারণা থেকে পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করেছেন খালেদা জিয়া। তাদের অনুপস্থিতিতে দলের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য নেতৃত্ব গ্রহণে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা জোবাইদা রহমানকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। এজন্যই সৌদি আরবে যাচ্ছেন জোবাইদা রহমানও। সেখানে এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হবে তাদের মধ্যে।
বিএনপি সূত্রমতে, মামলায় খালেদা জিয়া দ-িত কিংবা কারান্তরীণ হলে বিএনপির ঐক্য ধরে রাখতে তুরুপের তাস হিসেবে মেধাবী চিকিৎসক জোবাইদার রাজনীতিতে দ্রুত অভিষেক ঘটবে। সে ধরনের প্রস্তুতিই নিতে বলা হয়েছে তাকে। দলের দুঃসময় ও রাজনৈতিক সংকটময় এ পরিস্থিতিতে অনেক চিন্তা ভাবনা করে জোবাইদা রহমানের ক্লিন ইমেজকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপি।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, ভাঙন নিয়ে তারা এখনো খুব একটা ভাবছেন না। কারণ, এ পর্যন্ত দলের প্রভাবশালী অনেক নেতাই দল ছেড়ে গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। ১/১১ প্রেক্ষাপটে মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে দলের একটি বিশাল অংশ খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র করেও শেষ পর্যন্ত দল থেকে নিজেরাই মাইনাস হয়েছেন।
জাগো দল থেকে বিএনপিতে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার দলের ভাঙনের বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে যায়যায়দিনের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ভাঙন নিয়ে দলে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এ নিয়ে ভাবনারও কিছু নেই। কারণ এ পর্যন্ত ভাঙনের সব ষড়যন্ত্র তিনি সামনে থেকে দেখেছেন। যতবার দল ভাঙার চেষ্টা হয়েছে, তা সফলতার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রতিহত করেছেন। ভাঙন মোকাবেলা অভিজ্ঞতা তারই হয়তো সবচেয়ে বেশি। এজন্য এ নিয়ে ভাবনার কিছুই নেই।
জমিরউদ্দিন সরকার আরো বলেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ছিলেন। তার চলে যাওয়ায় বিএনপিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং তারই ক্ষতি হয়েছে। নিজ এলাকার মানুষ পর্যন্ত তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। একই অবস্থা কর্নেল অলি আহমেদের বেলাও। তিনি একা কিছু করতে পারেননি। ক’জন লোক আছে তার সঙ্গে এটা সবারই জানা। সর্বশেষ ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা চলে গিয়ে তার সঙ্গে তিন-চারজনকে জড়ো করেছিলেন। এই গোটা তিনেক লোক তাকেই বহিষ্কার করল। বিএনপিতে থেকে তারকাখ্যাতি পাওয়া এসব নেতার অবস্থা দেখে এখন আর দল ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে কেউ আছে বলে মনে করেন না। এরপরও কেউ যদি দল ছেড়ে অনত্র যায় তাতে যে যাবে সেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১/১১ প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ বিএনপি ভাঙনের চেষ্টার সময়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালনকারী দলের এই নেতা বলেন, তাকে যদি স্থায়ী কমিটি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, দল থেকে চলে যেতে বলা হয়, এরপরও বিএনপি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। সে সময়ের দলছুট নেতাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই সময়ে যারা বেইমানি করেছেন এরপর তারা নানান সময়ে বিএনপিতে ফিরতে চেষ্টা করেছেন। তাদের ফেরানোর ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসন উদার থাকলেও সাধারণ কর্মীরা সেসব নেতাদের গ্রহণ না করায় তারা রাজনীতি থেকে এক রকম ছিটকে গেছেন। এসব নেতাকে দিয়ে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্রকারীরা ভাঙনের হুমকি দেন। তবে এই হুমকিতে বিএনপি ভয় পায় না।
নিউজবাংলা/একে