নিউজবাংলা: ৮জুলাই, বুধবার:
ঢাকা : বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, দানাদার শস্য, তেল এবং মাংসজাতীয় পণ্যের দামের সাম্প্রতিক গড় সূচক পাঁচ বছরের

মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ এর কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না দেশের ভোক্তারা। মূলত দাম সমন্বয়ে খাদ্যপণ্য আমদানিকারক করপোরেটদের নির্লিপ্ততার কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভোক্তাসাধারণ। আর এ সুযোগে বাড়তি মুনাফা ঘরে তুলছেন ব্যবসায়ীরা।
গত বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘ফুড প্রাইস ওয়াচ’ প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন বছর ধরে বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবেই কমছে পণ্যের দাম। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টের তুলনায় চলতি বছরের মে মাসে সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে চিনির। এ সময়ে চিনির দাম ২৩ শতাংশ কমে যায়। এছাড়া একই সময়ে চালে ১৪ শতাংশ, গমে ১৮ শতাংশ, সয়াবিনে ৯ শতাংশ ও ভুট্টায় ৬ শতাংশ দাম কমেছে। অন্যদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় মে মাসে ভুট্টার দাম কমেছে ৪ শতাংশ। চাল, গম ও চিনির দাম কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশে এসব পণ্যের অঢেল উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষি উপকরণের দাম কমে আসায় সার্বিক উৎপাদন খরচও কমে এসেছে, যার প্রভাব পড়েছে পণ্যের দামে। তবে বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম হওয়া উচিত ৮২ টাকা। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯৩-১০০ টাকায়। অন্যদিকে খোলা সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারের দাম হওয়া উচিত ৬৭ টাকা ১০ পয়সা। অথচ সেটা বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়। একইভাবে পাম তেল ও চিনির দামও কাঙ্ক্ষিত দামের কাছাকাছি নয়।
উল্লেখ্য, ট্যারিফ কমিশন কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই পণ্যের আমদানি মূল্য, জাহাজ ভাড়া, প্যাকেটজাত বা বোতলজাতকরণ ও পরিবহন খরচ এবং ব্যবসায়ীর যৌক্তিক মুনাফা হিসাবে নিয়ে থাকে। তাদের হিসাবের বাইরে পণ্য বিক্রি হওয়াটা ভোক্তাস্বার্থের পরিপন্থী।
এ বিষয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর বলেন, ভোক্তাস্বার্থ উপেক্ষার পেছনে কিছু ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতা যেমন রয়েছে, তেমনি ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছার অভাবও দায়ী। বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম দেশের বাজারে কমে তো না-ই, উল্টো কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখানে সরকারের নজরদারির চরম অভাব রয়েছে। দুর্বল বাজার তদারকির কারণে ব্যবসায়ীরা প্রতারণার মাধ্যমে বাড়তি মুনাফা পকেটে পুরছেন।
দেশে আমদানি পণ্যের বাজার গুটিকয়েক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার বেশকিছু পণ্যে শুল্ক কমিয়ে আমদানি বাধা দূর করলেও সেসব পণ্যের দাম কমাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যহ্রাস কিংবা সরকারের পদক্ষেপের সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তা। এ অবস্থায় ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের তদারকি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাও পরিষ্কার করতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০-৩৫ লাখ টন গম, ১৪-১৭ লাখ টন চিনি, সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টন সয়াবিন তেল, ১০-১১ লাখ টন পাম অয়েল ও ২৮ লাখ টনের বেশি সার আমদানি করা হয়। তবে অন্যতম কৃষি উপকরণ সারের দাম দেশে দুই বছর ধরে সমন্বয় করে কমানো হলেও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম কমেনি।
দেশে আমদানি করা এসব পণ্যের দাম কমার পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। তাদের প্রতিবেদনে জ্বালানি, কৃষি, খাদ্য, শস্য, অন্যান্য ভোগ্যপণ্য, সার, কৃষিজাত কাঁচামাল, ধাতু ও খনিজসহ ৪৫টি পণ্যের দামের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে পণ্যের দাম কমবে কিনা, সেটি নির্ভর করে সরকারের আমদানিনীতি ও মজুদ ব্যবস্থাপনার ওপর। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদেরও সদিচ্ছা প্রয়োজন। কিন্তু দাম সমন্বয়ে আমদানিকারক ও বিপণনকারীদের কোনো উদ্যোগ নেই। তাছাড়া বাংলাদেশে বাড়তি চাহিদা মেটাতে আমদানির বিষয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। এর সুযোগ নেন আমদানিকারকরা। তাছাড়া যে হারে আমদানি মূল্য কমছে, সে হারে খুচরা ও পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম কমছে কিনা, তা তদারক করা হয় না। এজন্যই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের ভোক্তারা। একই কারণে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে প্রভাব রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল জানান, দেশের বাজারে পণ্যের দাম অনেকটাই নির্ভর করে জ্বালানি তেলের দাম কীভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে, তার ওপর। দুই বছর ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশের ভোক্তাদের আগের দামেই কিনতে হচ্ছে পণ্যটি। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে একদিকে ভোক্তারা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারের দাম সমন্বয় করা হলে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি আরো কমিয়ে আনা সম্ভব।
দেশের বাজারে প্রধান কয়েকটি ভোগ্যপণ্য, বিশেষ করে ভোজ্যতেল, গম, চিনি, পেঁয়াজ সরবরাহ করছে গুটিকয়েক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি পণ্য আমদানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে দাম নির্ধারণ বা বাজারে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া ভোগ্যপণ্যের দাম না কমানোর পেছনে কারসাজি আছে বলেও অভিযোগ করেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জের গম ব্যবসায়ী মো. রিয়াদুল ইসলাম জানান, দেশে বেশকিছু পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। বিশ্ববাজারে গমের দাম কমার খবর পাচ্ছি। কিন্তু দেশের আমদানিকারকরা গমের দাম কমাননি। মূলত মুষ্টিমেয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পণ্যটির আমদানিকারক হওয়ার কারণে বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে। সরকারিভাবে বাজার তদারক করে আমদানি মূল্যের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এসব পণ্যের দাম নির্ধারণের দাবি জানান তিনি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) বিশ্বজিৎ সাহা। তিনি বলেন, ভোক্তারা বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমার সুবিধা পাচ্ছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত পাকিস্তান ও নেপালের তুলনায় দেশের বাজারে পণ্যের দাম সঙ্গত পর্যায়ে রয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের তথ্য কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির সুপারিশ করা মূল্যতালিকা অনুসারে পণ্য বিপণন হবে।

নিউজবাংলা/একে