নিউজবাংলা: ১৬ জুলাই, বৃহস্পতিবার :

বিশেষ প্রতিনিধি:

পবিত্র হজ , তাবলিগ জামাত ও হজরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তিমূলক বক্ত্যব্যের দায়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব হারান। তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর টাঙ্গাইল জেলা প্রথম মন্ত্রীশূন্য হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৮ মাস মন্ত্রীশূন্য থাকার পর সেই শূন্যতা পূরণ করলেন অ্যাডভোকেট তারানা হালিম।

তারানা হালিম শুধু অভিভাবক শূন্যতাই পূরণ করেননি, টাঙ্গাইল জেলার ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন প্রথম নারী মন্ত্রী হিসেবে। তারানা হালিম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় জেলা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ব্যক্তিত্বের সাথেই তার একটি বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। ফলে তিনি মন্ত্রী হওয়ায় যেমন অভিভাবক শূন্যতা পূরণ করেছেন তেমনি আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

আলোচনা উঠেছে লতিফ সিদ্দিকী নাস্তিকতামূলক বক্তব্যের দায়ে মন্ত্রীশূন্য হয় টাঙ্গাইল। অথচ একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পবিত্র শবে কদরে শপথ নিলেন তারানা হালিম। এখন দেখার বিষয় লতিফ সিদ্দিকীর মতো বড় একটি অভিভাবকের আসন নিয়ে কতটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেন তারানা হালিম।

এদিকে তারানা হালিম মন্ত্রী হওয়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনার প্রস্তুতি চলছে। তার এলাকা টাঙ্গাইলের নাগরপুরে মিষ্টি বিতরণ করেছেন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। বৃহস্পতিবার প্রথম মন্ত্রণালয়ে অফিস শেষে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট দেলদুয়ার উপজেলা শাখার ইফতার মাহফিলে তারানা হালিমের অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।

এর আগে সরকারের বিভিন্ন সময়ে গঠিত মন্ত্রিসভায় টাঙ্গাইলের ১৪ জন রাজনীতিক ২১টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, টাঙ্গাইলের সন্তান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আর ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন হুমায়ুন খান পন্নী।

স্বাধীনতার পূর্বাপর রাজনীতিতে টাঙ্গাইলের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছিল টাঙ্গাইলের রাজনীতিকদের অগ্রণী ভূমিকা। ওই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে যারা নাম লিখিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শামছুল হক। যাঁদের হাতে ছিল একসময় পুরো বাংলার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ। পরবর্তী সময়ে তাদের নেতৃত্বের অনুসারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার যোগ্যতা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা আর কৌশলের মধ্যদিয়ে পূর্ববঙ্গের পুরো রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কর্তায় পরিণত হন। তার নেতৃত্বে চলতে থাকে পাকিস্তানিদের শোষণ, নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ওই সংগ্রামেও টাঙ্গাইলের রাজনীতিকদের ছিল বিশাল ভূমিকা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের জ্বালাময়ী ভাষণে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে শিহরণের সৃষ্টি হয়েছিল। রক্তে সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রেরণা। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ওই সংগ্রামেও টাঙ্গাইল পিছিয়ে ছিল না। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী। এমনকি যুদ্ধকালীন সময়ে মুজিব বাহিনীও গঠিত হয়েছিল টাঙ্গাইলের রাজনীতিক আলমগীর খান মেনুর নেতৃত্বে। ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল। তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্ট ও পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন টাঙ্গাইলের কৃতিসন্তান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত প্রথম মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন টাঙ্গাইলের জননেতা আব্দুল মান্নান। পরবর্তী সময়ে মোস্তাক সরকার গঠন করলে সেখানেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্বর তিনি প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মেজর জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায়ও স্থান পান টাঙ্গাইলের আব্দুর রহমান ও নূর মোহাম্মদ খান। তারা যথাক্রমে গণপূর্ত, ধর্মমন্ত্রী এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। আঁততায়ীর গুলিতে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আব্দুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায়ও টাঙ্গাইলের আব্দুর রহমান ও নূর মোহাম্মদ খান দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৩ সালে লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, গণপূর্ত ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান। সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন নূর মোহাম্মদ খান আর উপ-পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ওয়াজেদ আলী খান বাল্টিন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করলে টাঙ্গাইলের লুৎফর রহমান খান আজাদ ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর নৌপরিবহন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন স্বাধীনতার ইস্তিহার পাঠক শাহজাহান সিরাজ। আর ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন হুমায়ুন খান পন্নী।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ওই মন্ত্রিপরিষদে সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।

২০০১ সালে বিএনপি পুনরায় সরকার গঠন করলে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদে বস্ত্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন শাহজাহান সিরাজ। প্রথমে ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং পরে শিল্প প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন লুৎফর রহমান খান আজাদ। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তী। শিক্ষা উপ-মন্ত্রী ও তথ্য উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম পিন্টু।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান কৃষিবিদ ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ভোলা। আর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন আরেক রাজনীতিক আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠনের পর ওই মন্ত্রিসভায় টাঙ্গাইলের একমাত্র রাজনীতিক আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

প্রসঙ্গত, মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর আমেরিকার পালকি কমিউনিটি সেন্টারে টাঙ্গাইল সমিতির সংবর্ধনা সভায় হজ, তাবলিগ, প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও হজরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করেন। লতিফ সিদ্দিকীর চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে সারাদেশ ও মুসলিম জনতা ফুঁসে উঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকা থেকেই লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দেশে ফিরে ৩ অক্টোবর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিত্ব ও দল থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। মহামান্য প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ হজ পালন শেষে দেশে ফিরে এসে ১২ অক্টোবর দুপুরে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণ করেন। এই অপসারণের মধ্য দিয়ে লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব হারান। এর সাথে সাথে বর্তমান মন্ত্রিসভায় টাঙ্গাইলের প্রতিনিধিত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। একই সাথে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর টাঙ্গাইলও মন্ত্রিত্বশূন্য হওয়ার ইতিহাস সৃষ্টি হয়।

নিউজবাংলা/একে