নিউজবাংলা: ১১ আগস্ট, মঙ্গলবার:
ঢাকা: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এ ছাড়া অপর আসামি খান আকরাম হোসেনের আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার দুপুরে এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
এ মামলার তিনজন আসামির মধ্যে অন্যজন আব্দুল লতিফ তালুকদার গত ২৮ জুলাই মারা গেছেন। ফলে গত ৫ আগস্ট তাকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন ট্রাইব্যুনাল।
২৩ জুন দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিল। এরপর গত সপ্তাহে আদালত রায়ের জন্য ১১ অগাস্ট দিন ধার্য করেন।
২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ আনে অভিযোগ গঠন করে আন্তজাতিক ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে ৩টি করে অভিযোগ আনা হয়েছে।
২ ডিসেম্বর তিন আসামির বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর সাইয়্যেদুল হক সুমন।
গত বছরের ২ ডিসেম্বর থেকে গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত সিরাজ-লতিফ-আকরামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হেলাল উদ্দিনসহ ৩২ জন সাক্ষী।
এরপর গত ৬, ৭ ও ২১ এপ্রিল আসামিদের পক্ষে পাঁচজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। এরা হলেন- মো. আমজাদ শেখ, সরদার আব্দুল মান্নান, আব্দুর রশিদ মল্লিক, ইউসুফ আলী দিহিদার ও মো. ফেরদৌস খান।
২০১৪ সালের ১৫, ১৭ ও ২৩ জুন রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমন ও প্রসিকিউটর মোশফেক কবির। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ১৭ ও ২১ জুন সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল আহসান এবং খান আকরাম হোসেন ও লতিফ তালুকদারের পক্ষে ব্যারিস্টার এম সারওয়ার হোসেন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাটের কচুয়ার শাঁখারীকাঠি বাজারে ৪২ জনকে গণহত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ ছয়টি অভিযোগে ২০০৯ সালে সিরাজ মাস্টারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।
ট্রাইব্যুনাল গত ১০ জুন এই তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে কচুয়া থানা পুলিশ পরদিন লতিফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ১৯ জুন আকরাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয় রাজশাহী থেকে। ২০ জুলাই গ্রেপ্তার হন সিরাজ মাস্টার।
সাত অভিযোগ
অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ১৩ মে দুপুর ২টার দিকে রাজাকার বাহিনীর বাগেরহাট সাব ডিভিশনের তৎকালীন ডেপুটি কমান্ডার শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন রাজাকার এবং বেশ কিছু স্বাধীনতাবিরোধী বাগেরহাট জেলার রঞ্জিতপুর গ্রামে ঘিরে ফেলে। তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
ওই সময় সিরাজুল হক এবং তার সহযোগীরা প্রায় ৪০-৫০ জন হিন্দুকে হত্যা করে। এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্রিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ২১ মে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২/৩ হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাগেরহাটের রামপাল থানার ডাকরার কালীমন্দিরে জড়ো হন। সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এ হামলা চালিয়ে সেদিন ৬/৭শ’ জনকে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে ‘কসাই সিরাজ’ বলে কুখ্যাত শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে একা অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৩: একাত্তরের ১৮ জুন সকাল ১০টার দিকে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্য এবং ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকার বেসরগাতী, কান্দাপাড়া গ্রাম এবং কান্দাপাড়া বাজার থেকে ২০ জনকে অপহরণ করে।
তাদেরকে কান্দাপাড়া বাজারে আটকে রেখে নির্যাতন করে সিরাজ মাস্টার ও তার সহযোগীরা। তাদের নির্যাতনে ১৯ জন নিহত হন। অপহৃত শেখ সুলতান আলী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, যিনি পরে ১৯৮৪ সালে মারা যান।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বাগেরহাটের সদর থানার চুলকাঠিতে হামলা চালিয়ে ৫০টি বাড়ি লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওইদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭ জন নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা। এ অভিযোগেও সিরাজ মাস্টারকে একা অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনসহ অন্যান্য অমানবিক কাজের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৫: মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ নভেম্বর দুপুর ৩টার দিকে সিরাজ মাস্টার, স্থানীয় রাজাকার নেতা খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালকদারসহ ৫০-৬০জন রাজাকার সদস্য মিলে কচুয়া থানার শাঁখারিকাঠি হাটে হামলা চালায়।
সেখানে তারা ৪০ জন হিন্দু এবং দুই স্বাধীনতা সমর্থককে আটক করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাগেরহাটের কচুয়া থানার বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরস্ত্র ৫ জনকে অপহরণ ও আটক করে সিরাজসহ তিনজনের নেতৃত্বে রাজাকাররা। পরে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের তেলিগাতীতে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদারকে আটক করার পর তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেন আসামিরা।
এ ঘটনায় খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারের বিরুদ্ধে অপহরণ ও খুনের অভিযোগ আনা হয়।

নিউজবাংলা/একে