নিউজবাংলা – ২৩ সেপ্টেম্বর, বুধুবার:
ঢাকা: কখনো ভাবেননি এভাবে তারকা বনে যাবেন। তবে ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি প্রচ- আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু মা জোর করে শেখাতে শুরু করলেন গান। মায়ের ইচ্ছের কাছে আর পেরে ওঠেননি।
তাকে মায়ের ইচ্ছের কাছে হার মানতে হয়েছে আরও একবার, তবে সেবার বিজয়ীর বেশেই ফিরেছেন। নাটক, বিজ্ঞাপন কিংবা সিনেমা সব মাধ্যমেই যার সমান পদচারণা। অভিনয়ের পাশাপাশি করছেন সাহিত্য চর্চা। তিনি সবার প্রিয় অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা সাহা মীম। সাত রং-এর এবারের আয়োজনে তার অভিনয় জীবনের আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ রিয়াদ
বিদ্যা সিনহা মীম মানেই ভিন্ন কিছু। তাই ক্যারিয়ার শুরুটাও ছিল খুব ধীরে-সুস্থে। তাড়াহুড়ো কখনোই পছন্দ করেন না তিনি। লাক্স-এ আসার আগেও মাকে জানিয়েছিলেন এখন না পরে। নিজেকে তৈরি করার বিষয়গুলো যেন মীমের মজ্জাগত। হয়ত কলেজ শিক্ষকের মেয়ে বলেই এমনটা তার পক্ষে সম্ভব। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য কিছুটা সময়ও নিয়েছেন তিনি। হাজারও প্রতিযোগীকে হারিয়ে যিনি বিজয় মুকুট ছিনিয়ে আনেন, তিনি সাধারণ কেউ নন। অবশ্য প্রতিযোগিতার বিচারকরা সে আভাস আগেই দিয়েছিলেন। তারপর থেকে মীম নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন তিনি কতটা যোগ্য।
মীমের শুরুটা সবার মতো নয় এটা একবাক্যেই বলা যায়। ক্যারিয়ার সূচনাতেই পেয়েছেন লাক্স-এর মতো বড় একটি প্লাটফর্ম। আর তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা হিসেবে তিনি পেয়েছেন হুমায়ুন আহমেদের মতো গুণীজনকে। হুমায়ুন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্র দিয়ে অভিনয় শুরু করা মীম হয়ত সে কারণেই সবার থেকে একটু এগিয়ে থাকবেন।
মীমের ক্যারিয়ারটাও বিস্ময়কর। তখন তিনি কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসা গভ. গার্লস হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়েন। কোনো প্রতিযোগিতায় নিজের নাম নিবন্ধনের ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। শুধু মায়ের ইচ্ছেতেই লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৭ সালে নাম নিবন্ধন করেন। কিছুদিন পর প্রাথমিক বাছাইয়েও ডাক পেয়ে যান। আর যখন এসএসসি রেজাল্ট বেরিয়েছে, ঠিক ততদিনে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টারের মূল পর্বে পৌঁছে যান মীম। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে একাদশ শ্রেণিতে থাকতেই ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৭’ নির্বাচিত হন। ঠিক সেই বয়সে সুপারস্টার খেতাব অনেক বড় প্রাপ্তি। মীম বলেন, মায়ের স্বপ্নটাই সত্যি হলো।
সুপারস্টার বিজয় মুকুট সযতেœ পাশে রেখেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন মীম। কলেজ জীবন শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। তবে সেখানে পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাই বলে কী মীম পড়াশোনা বন্ধ করে দেবেন? মোটেই না। তাই অনেকটা নিজ উদ্যোগেই ২০১২ সালে আবারও ভর্তি হয়েছেন সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগে। আর সেখানেই পড়াশোনা করছেন স্নাতক শেষ বর্ষে।
‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৭’ নির্বাচিত হওয়া মীম সে বছরই একটি দুটি করে টিভি নাটকে কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালে হুমায়ুন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ সিনেমার মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। আর এই সিনেমায় মীমের বিপরীতে অভিনয় করেন জাহিদ হাসান ও শাওন। ‘আমার আছে জল’ সিনেমার মাধ্যমে অনেকেই হয়ত বাংলা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ সুপারস্টারকে দেখেছেন।
তারপর ২০০৮ সালে জাকির হোসেন রাজুর ‘আমার প্রাণের প্রিয়া’ সিনেমায় শাকিব খানের বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসেন এই লাস্যময়ী তারকা। ‘আমার প্রাণের প্রিয়া’ সিনেমা মীমকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। আর এই সিনেমার মাধ্যমে তার পরিচিতিও বেড়ে যায় বহু গুণে। মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা কিংবা পপির পর বাংলা সিনেমায় বলার মতো নতুন কেউ আসেননি। সবার ধারণা ছিল এই আক্ষেপ হয়ত কিছুটা হলেও মীম গোচাবেন। তবে এই সিনেমার পর সবাইকে নিরাশ করে মীম অনেকটা চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। বনে যান পুরোদস্তুর নাট্যাভিনেত্রী।
প্রথমে সিনেমা ছেড়ে পর্দার আড়ালে যাওয়ার মতো বিষয় মনে হলেও কিছুদিনের মধ্যেই টিভি নাটকে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন এই সুপারস্টার। নাটকে এসেও মীম ব্যাপক সফলতা পান। ভক্ত ও দর্শক অনেকের কাছেই মীম এদেশীয় অভিনেত্রীদের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। শারীরিক গঠন কিংবা উচ্চতা এসবই তাকে সবার চেয়ে ভিন্ন করেছে। বন্ধুদের কেউ কেউ দুষ্টুমি করে বলেন, ‘বাংলাদেশের একমাত্র বলিউড তারকা।’ মীম-ভক্তদের মধ্যে এই কথাটি অহরহ শোনা যায়। আর বাংলাদেশি কোনো সেলিব্রেটি অভিনেত্রী হিসেবে তার ফেসবুক ফ্যান পেইজটিই প্রথম ভেরিফাইড হয়। আর এতেই অনুমান করা যায় অনলাইনে মীম-ভক্তদের কি আনাগোনা।
কাজের ব্যাপারে মীম বরাবরই সচেতন। সময়মতো শুটিং ইউনিটে আসার ব্যত্যয় ঘটে না কখনো। তবে দুটো সিনেমা করার পর হঠাৎ করেই পুরোদস্তুর নাট্যাভিনেত্রী বনে যান তিনি। রুপালি পর্দা ছেড়ে হয়ে যান ছোট পর্দার মানুষ। ভক্তদের অনেকের কাছেই তিনি শুধু নাটকের মানুষ হয়েই আছেন। আবার কারও কাছে শুধুই সিনেমার। অবশ্য এর বড় একটা কারণও আছে। সিনেমা ছেড়ে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একাধারে টিভি নাটকে কাজ করে গেছেন। তাই দর্শকরা ধরেই নিয়েছেন সিনেমায় নয় নাটকেই থাকবেন মীম। তবে ২০১৪ সালে সবার ভাবনারই অবসান ঘটান এই গ্ল্যামার গার্ল।
২০১৪ সালে খালিদ মাহমুদ মিঠুর ‘জোনাকির আলো’ ও মোস্তফা কামাল রাজের ‘তারকাটা’ ছবি দিয়ে আবারও চলচ্চিত্রে পা রাখেন মীম। ২০১৫ সালে মুক্তি পায় মীম অভিনীত ‘পদ্ম পাতার জল’। তন্ময় তানসেনের এই সিনেমায় তার বিপরীতে অভিনয় করেন মডেল ইমন। আর ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘সুইট হার্ট সিনেমায়’ বাপ্পি চৌধুরী ও রিয়াজের বিপরীতেও কাজ করেন তিনি।
কোন কাজের পর প্রচুর দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে মীম বলেন, ‘আসলে প্রথম চলচ্চিত্রের পর থেকেই একটু একটু পরিচিতি বাড়তে থাকে। জাকির হোসেন রাজুর ‘আমার প্রাণের প্রিয়া’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে বেশ আলোচিত হই। তবে ২০১০ সালে মাহফুজ আহমেদের ‘শেষের কবিতার পরের কবিতা’ টিভি নাটকটি প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। আমার কাছে এই নাটকের অনুভূতি দুর্দান্ত। নোভেল ভাই এবং আরিফিন শুভর সঙ্গে অভিনয় করা ওই নাটকটির সাড়া ছিল ব্যাপক। একজন টিনএজারের গল্প নিয়ে পুরো নাটকের প্লট তৈরি করা হয়। এরপর থেকে আমি প্রচুর টিভি নাটকে কাজ করতে শুরু করি।
জল তরঙ্গ, চলো না বৃষ্টিতে ভিজি, সিট খালি নাই, বাইসাইকেল, ম্যানপাওয়ার, শেষের কবিতার পরের কবিতা, নীল জোছনায় কালো সাপ, ভালোবাসি তাই, উইল ইউ মেরি মি, ওভার কনফিডেন্ট, লাভ ব্যাংক, ফেল্টু চেয়ারম্যান, আন্ত্রিক ভালোবাসা, ট্রাম্পকার্ড, কবির জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে এমন অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেন মীম। ২০১২-১৩ সাল থেকে গ্রামীণফোন, ওয়ালটন, যমুনা ইলেকট্রনিক্স, রাঙাপরী মেহেদী, আপন জুয়েলার্সসহ বেশকিছু ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছেন তিনি। নাটক, সিনেমা কিংবা বিজ্ঞাপন সবকিছুতেই মীম পারদর্শী। আর তাই সব মাধ্যমে তার জনপ্রিয়তাও আকাশচুম্বী।
মীমের অভিনয়ের বিষয়গুলো একটু অদ্ভুতুরে। হঠাৎ ২০১৪ সাল থেকে তিনি টিভি নাটকে অনিয়মিত হয়ে গেছেন। বড় বড় বিজ্ঞাপন ছাড়া তাকে ঠিভিতে খুব কমই দেখা যায়। মীম টিভি নাটক করার প্রসঙ্গে বলেন, অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। প্রথমে গল্পের মানের দিকে কমই খেয়াল করেছি। এখন একটু একটু দেখে কাজ করার চেষ্টা করছি। আসলে দর্শক ভালো কিছু দেখতে চায়। কিন্তু আমরাই তাদের ভালো কিছু দিচ্ছি না। তবে দর্শদের নতুন চমক দেব। সেই চমকের রেশ ধরেই তিনি নাম লিখিয়েছেন কলকাতার সিনেমায়। লে হালুয়া লে, চ্যালেঞ্জ, লাভেরিয়া, জানেমান, রংবাজ-এর মতো ব্লকবাস্টার সিনেমার পরিচালক রাজা চন্দ-এর ‘ব্ল্যাক’ সিনেমায় অভিনয় করেন মীম। ব্ল্যাক সিনেমায় তার বিপরীতে অভিনয় করেন কলকাতার আরেক সুপারস্টার সোহম চক্রবর্তী। কলকাতার দেবের সঙ্গে এর আগে একটি ফিল্মে কাজ করার কথা হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি আর করেননি। নতুন কোনো ছবির কথা জিজ্ঞেস করলে মীম বলেন, ব্ল্যাক ছাড়াও আরও তিনটি ছবি হাতে আছে। অভিনেত্রী তানিয়া আহমেদের ‘গুড মর্নিং লন্ডন’, রেদওয়ান রনির ‘মরীচিকা’ ও কলকাতার অঞ্জন দত্তের ‘মনবাক্স’। টিভি নাটক কী ছেড়ে দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে মীম বলেন, আসলে এটা ঠিক নয়। তবে ‘আপাতত টিভি নাটকে অভিনয় করছি না। যেহেতু ফিল্মে কাজ করছি, তাই এই জায়গাটাতেই আপাতত থাকতে চাই।’
বাংলা নাটক কিংবা সিনেমায় সব্যসাচী নয় বরং বহুমাত্রিক প্রতিভা রয়েছে এই গ্ল্যামার গার্লের। শুধু অভিনেত্রী বা মডেল নন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি লেখকও বটে। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার দুটি গল্পের বই। ‘শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভেজা’ (২০১২) ও ‘পূর্ণতা’ (২০১৩)। মীম নিজের কাজের জন্য পেয়েছেন অনেক সম্মাননা। আর নিজের কাজগুলো ভালোভাবে করে যাওয়ার প্রত্যাশাই করেন সব সময়। আর কাজের মধ্য দিয়ে দর্শকদের মনে ঠাঁই পেতে চান এই গ্ল্যামার গার্ল।
নিউজবাংলা/একে