নিউজবাংলা: ৯ অক্টোবর, শুক্রবার:
ঢাকা: দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় ধরে লন্ডন সফরে খালেদা জিয়ার প্রাপ্তি নিয়ে অালোচনা শুরু হয়েছে বিএনপিতে। দৃশ্যত দলীয় নেতারা তার সফরকে ‘একান্ত ব্যক্তিগত ও চিকিৎসাকেন্দ্রীক’ হিসেবে দেখাতে চাইলেও কার্যত গভীর রাজনৈতিক কারণ নিহিত ছিল বিএনপি নেতার এই লন্ডন সফরে।

তবে এক মাসের বেশি সময়ের এ সফরে বিএনপির রাজনৈতিক পজিশন ও বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন প্রশ্নে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সম্মতি এবং সক্রিয়তা অাদায়ের বিষয়টিও প্রত্যাশিতভাবে পূরণ হয়নি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের সঙ্গে বিগত দিনের সম্পর্ক অারও বেশি শক্তিশালী হয়েছে বলেই মনে করে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলের সূত্রগুলো।
১৫ অক্টোবরের পর দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া
সংশ্লিষ্ট প্রায় কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসের মাঝামাঝি বা অন্তত ১৫ তারিখের অাগে লন্ডন সফর থেকে দেশে ফিরছেন না বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার চোখের অপারেশনের কারণে অারও অন্তত এক থেকে দেড় সপ্তাহ সময় তাকে চিকিৎসকদের অধীনে থাকতে হবে। এ ব্যাপারে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার জানান, শুনেছি দু সপ্তাহের মধ্যে ফিরতে পারেন। এর বাইরে কিছু তো জানি না। বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান অাবদুল্লাহ অাল নোমান বলেন, ৮ তারিখে ফেরার তো কথা ছিল। কিন্তু চোখের চিকিৎসার কারণে এবং চিকিৎসকদের অ্যাপয়েনমেন্ট এর কারণে হয়তো একটু বিলম্ব হবে।
একই মত দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান খান দুদু। তিনি জানান, খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তারিখ ঠিক হয়নি। তবে তার ধারণা, এ মাসের মাঝামাঝি হতে পারে। দেশে ফেরার দিনক্ষণ স্থির হয়নি বলে জানিয়েছেন অারেক উপদেষ্টা ইনাম অাহমেদ চৌধুরী। তার মতে, এখনও কোনও ডেট ঠিক হয়নি। তবে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন অাহমদ জানান, এ মাসের ১৫ তারিখের পর দেশে ফিরতে পারেন খালেদা জিয়া।
কি নিয়ে ফিরবেন খালেদা জিয়া
বিএনপি ও জোটের সূত্রমতে, ১৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, দীর্ঘ প্রায় অাট বছরের বেশি সময় পরে নিজের বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলে তারেক রহমান ও তার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ। একজন মা হিসেবে খালেদা জিয়া এবং ছেলে হিসেবে তারেক রহমানের কাছে এ বিষয়টি অগ্রগণ্য। তবে পারিবারিক এ সম্পর্কের ঊর্ধ্বে সবচেয়ে বেশি অালোচ্য ছিল, বিএনপির সংগঠন গোছানোর চলমান প্রক্রিয়া, পরবর্তী নির্বাচন প্রশ্নে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দলীয় সম্পর্কের উন্নয়ন, অাওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর অাচরণ কী রূপ নেবে এবং পরবর্তীতে ক্ষমতায় এলে পশ্চিমা দেশগুলোর বিষয়ে ‘বিএনপি সরকারের’ অবস্থান বা নীতি কী হবে। পাশাপাশি পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে সরকারের কয়েকজন নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন খালেদা জিয়া, এমন খবরও চাউর হয়েছিল ঈদের সময়।
সূত্রের দাবি, এক্ষেত্রে অনেক বেশি গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে। গোপন রাখা হয় লন্ডনে খালেদা জিয়ার অাবাসস্থলটিও। প্রচার ছিল, স্থানীয় একটি হোটেলে তারেক রহমানের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন খালেদা জিয়া। এর বাইরে কোনও তথ্যই প্রকাশিত হয়নি অদ্যাবধি।
জানা যায়, পরবর্তী নির্বাচন-প্রশ্নে সরকারের মধ্যে এক ধরনের নমনীয়তা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘ সফরের পর পুরো হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়। এর অাগে খালেদা জিয়া ঈদের দিন লন্ডনের একটি কনভেনশন সেন্টারে তার বক্তব্যে বলেছিলেন, অাওয়ামী লীগের মধ্যে দেশপ্রেমিক রয়েছেন। যদিও দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে ঠাট্টার ছলে বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, মূলত ঈদের অাগেই নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের নমনীয়তা কাজ করেছে সরকারের মধ্যে। ধারণা ছিল, সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। তবে রাশিয়া অাইএস লক্ষ্য করে সিরিয়ায় হামলা শুরু করার পরই বাংলাদেশ সরকারের পরিস্থিতি পুরো পরিবর্তন হয়। সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশ পুরনো অবস্থান থেকে সরে অাসে। নির্বাচন-প্রশ্নে ২০২১ সালের অাগে কোনও অালোচনাই তোলা হবে না বলেও গোয়েন্দা সূত্রটি দাবি করে।
গোয়েন্দা সূত্রটির তথ্য, রাশিয়া সিরিয়ায় অাইএসের ওপর ও অাসাদবিরোধী অংশের ওপর হামলার পরই বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন অাসে। এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে সরকারের উপরমহল যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশিয়া-ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকেই বেশি ঝুঁকেছে। এ কারণে নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর পূর্বাপর চাপ থাকলেও অাদতে এসবের কোনও গুরুত্ব দিতে চায় না সরকার। এ প্রসঙ্গে ইনাম অাহমেদ চৌধুরী বলেন, রাশিয়া সিরিয়া-হামলার তাৎপর্য অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী। বাংলাদেশও এর পরোক্ষ প্রভাবে পড়বে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এ হামলার বিষয়টি কতটা গুরুত্ব রাখছে বা রেখেছে, সেটি এখনই বলাটা সমীচীন নয়।
উল্টোদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের দলীয় সম্পর্ক উন্নয়নে অনেকটাই সফল হয়েছেন খালেদা জিয়া। এটা দলীয় কয়েকজন নেতার দাবি। তারা মনে করেন, পশ্চিমাদেশগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করেই এসেছেন খালেদা জিয়া। পাশাপাশি পরবর্তী অান্দোলন ও সরকারবিরোধী মুভমেন্টে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন অাদায়েও অাগের চেয়ে বেশি সফলতা এসেছে এবার। এ কারণে অাসন্ন বিএনপির সংগঠন গোছানো এবং পরবর্তী অান্দোলনে এর স্পষ্টতা পরিষ্কার হবে বলেও নেতারা জানান। এক্ষেত্রে বিএনপি নেতা ড. ওসমান ফারুক, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার অাবদুর রাজ্জাকসহ অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা দেশগুলোয় কাজ করছেন। এছাড়া অাওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ অাশরাফুল ইসলামও দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অাছেন। তার সফরের সময় থেকে গুঞ্জন ছিল, খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বৈঠক হতে পারে। যদিও ঈদের পর স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে ওই বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।
তবে বিএনপির সিনিয়র নেতা, সাবেক স্পিকার জমির উদ্দীন সরকার তেমনটি মনে করেন না। তার মতে, খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরের সফলতা-ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই। তিনি তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সফরে যাননি। তিনি পারিবারিক ও চিকিৎসার কারণে গিয়েছেন। ফলে, এখানে সফলতা ব্যর্থতার কথা অাসা সঠিক না। এছাড়া সৈয়দ অাশরাফের মন্তব্য না করার মানে এই নয় যে, খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে- সেটির সত্যতা তুলে ধরে। জমির উদ্দীন সরকার মনে করেন, বৈঠক হলে স্থানীয় পত্রিকাগুলোয় হলেও খবর প্রকাশিত হতো।
একই মতামত দিলেন বিএনপির সহমর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন অাহমদ। তিনি মনে করেন, ৮ বছরের বেশি সময় পর অাপনজন, ছেলে, নাতি-নাতনীদের সঙ্গে দেখা করতে পারাটাই মা ও দাদী হিসেবে খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় পাওনা। দেশে ফেরার পর শুধু এই সাক্ষাৎটিই তার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সাধন করবে। এছাড়া এই সফরের সফলতা বা ব্যর্থতা কি অাছে? একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটি দেশে গেলে সেখানে তো কত কিছু ঘটে।
লন্ডন সফরে সফলতার বা ব্যর্থতার বিষয়টিকে অশুদ্ধ মনে করেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম অাহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, অামার মনে হয় না, ম্যাডামের সফরের সঙ্গে রাজনৈতিক কোনও তাৎপর্য অাছে। দলীয় ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাংগঠনিক ও দলীয় অান্দোলন-কর্মসূচি নিয়ে অালোচনা করছেন বা করবেন। কিন্তু পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অাদতে কোনও অালোচনা বা পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে অালোচনা হতে পারেন না।
সবমিলিয়ে শতভাগ সফলতা না এলেও লন্ডনফেরত খালেদা জিয়া অাগের চেয়ে অনেকখানি শক্তিশালী হয়ে অাসবেন। নিজস্ব মনোবল ও পশ্চিমা অন্তত তিনটি রাষ্ট্রের পুরো সমর্থন নিয়ে পরবর্তীতে অান্দোলনে কাজে লাগাবেন বিএনপিপ্রধান। এমন তথ্য বিএনপির বিদেশপলিসিতে কাজ করছেন এমন এক নেতার। জমির উদ্দিন সরকার মনে করেন, রাজনৈতিক দল তো রাজনীতি ছাড়া টিকে না। তো বিএনপিও কর্মসূচি দেবে। এখানে লন্ডন যুক্ত করার কিছু নেই। অান্দোলনে নামবে বিএনপি।

নিউজবাংলা/একে