মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশী ৩ লাখ
নিউজবাংলা: ১৫ আগস্ট, শনিবার:
মালয়েশিয়ায় প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক এখনো অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এসব বাংলাদেশীকে বৈধতার সুযোগ না দিয়ে নতুন করে বিজনেট টু বিজনেস পদ্ধতিতে কর্মী নেয়ার ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
এ লক্ষ্যে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত সপ্তাহে বাংলাদেশী সফর করে গেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে স্বল্প খরচে কর্মী রফতানি শুরু হতে পারে।
এ দিকে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ বলছেন, মালয়েশিয়ায় যারা এখনো অবৈধভাবে অবস্থান করছেন তাদের আর সে দেশের সরকারের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। এটা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। অভিবাসন বিশেষজ্ঞের মতে, মালয়েশিয়াতে কলিংসহ নানা ভিসায় আসা তিন লাখ অবৈধ কর্মী এখনো সার্ভিস সেক্টরসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মরত আছেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকে পুলিশ অভিযান আর কোম্পানিতে কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে ট্রাভেল পাসে ওই দেশ ছাড়তে শুরু করেছেন।
এ দিকে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার শুরু না হতেই দালাল চক্রের তৎপরতা ফের দেশ-বিদেশে শুরু হয়েছে। শোনা যাচ্ছে মালয়েশিয়ার সাব-এজেন্টরা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে শ্রমিকের বিপরীতে চাহিদাপত্র কিনতে প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। একেকটি চাহিদাপত্রের দাম উঠেছে সাড়ে পাঁচ হাজার রিংগিট (দেড় লাখ টাকা)। ইতোমধ্যে যেসব চাহিদাপত্রের অনুমোদন বের হয়েছে, এর কোনটির বিপরীতে না-কি বেশির ভাগ শ্রমিকের কাজ করার সুযোগই নেই বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এ চক্রের তৎপরতার কারণে বিগত দিনগুলোতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তাই যাচাই বাছাই না করে হাইকমিশন থেকে চাহিদার বিপরীতে সত্যায়ন দেয়া হলে আবারো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীদের মালয়েশিয়ায় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখনই দুই দেশের সরকারের নীতিনির্ধারকদের তৎপর হওয়ার পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
মালয়েশিয়ায় অবস্থান করা একাধিক অবৈধ শ্রমিক নাম না প্রকাশের শর্তে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বিজনেস টু বিজনেস পদ্ধতিতে শুনছি লোক আসবে। তবে কিভাবে এবং কোনো প্রক্রিয়ায় আসবে তা সরকারিভাবে ঠিকঠাক হয়নি। কিন্তু তার আগেই মালয়েশিয়ায় থাকা দেশী-বিদেশী এজেন্টরা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে চাহিদাপত্র সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। একেকটি চাহিদাপত্র বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার রিংগিট করে। তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, মালয়েশিয়ার শাহ আলম শফিকুল ইসলাম নামে এক এজেন্ট থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি যশোর। তিনি সম্প্রতি একটি কোম্পানি থেকে দুই হাজার কর্মীর নামে চাহিদাপত্রের অনুমোদন পেয়েছেন বলে দাবি করছেন। শাহ আলম এসব চাহিদার বিপরীতে শ্রমিক সংগ্রহের লক্ষ্যে সাব-এজেন্টদের কাছে ধরনা দেয়া শুরু করেছেন। তিনি প্রত্যেক শ্রমিকের চাহিদার জন্য বাংলাদেশী টাকায় দেড় লাখ টাকা করে চাচ্ছেণ। তবে শফিকুল যাদের কাছে চাহিদাপত্র বিক্রি করতে চাচ্ছেন তাদের তিনি এও বলে দিচ্ছেন, ‘দুই হাজার চাহিদাপত্রের মধ্যে ৭০০ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বাকিদের এখানে এসে কাজ খুঁজে নিতে হবে’। তখন মধ্যস্বত্তভোগীদের কেউ কেউ শফিকুলকে বলছেন, ‘আপনি থাকেন মালয়েশিয়াতে। আর আমরা ঢাকা থেকে লোক জোগাড় করে আনব। পরে লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসে এসব লোক প্রতারিত হলে তখন আমাদের কী অবস্থা হবে। এমন কথা বলার পর ওই এজেন্ট শফিকুল তাদের জানান, দুই বছরের ভিসাতো ঠিকই আছে। এতে কোনো সমস্যা হবে না। শফিকুলের মতো অনেক এজেন্ট এখন মালয়েশিয়ায় গিয়ে চাহিদাপত্র সংগ্রহ শুরু করেছেন। এ চাহিদাপত্রের ফটোকপি দেখিয়ে পাসপোর্ট আর নগদ ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম জমা নিচ্ছেন ঢাকার রিক্রুটিং ও ট্রাভেল এজেন্সির মনোনীত দালালরা।
এক প্রশ্নের উত্তরে অবৈধ ওই শ্রমিকেরা বলেন, মালয়েশিয়াতে বর্তমানে পুলিশি ধরপাকড় নেই। তবে এখনো কলিং, প্রফেশানাল, স্টুডেন্ট ভিসা ও সাগরপথে আসা প্রায় তিন লাখ অবৈধ শ্রমিক এখানে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে সার্ভিস সেক্টরের পুরনো শ্রমিক ৩০-৫০ হাজার রয়েছেন। মালয়েশিয়া সরকার এবার ঘোষণা দিয়েছে, পুরনো শ্রমিকদের ভিসা নতুন করে আর নবায়ন করা হবে না। যার কারণে পুরনো যারাই ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট জমা দিতে যাচ্ছেন তাদের পাসপোর্টেই লাল সিল মারা হচ্ছে। তাই উপায় না পেয়ে অবৈধ শ্রমিকেরা হাইকমিশন থেকে ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করে দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে পুলিশি অভিযানে ধরা পড়ে জেলখানায় এখনো বহু শ্রমিক আটকে আছেন বলে তারা দাবি করেন।
গত রাতে মালয়েশিয়ায় থাকা অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. শংকর চন্দ্র পোদ্দারের সাথে যোগাযোগ করা হলে নয়া দিগন্তকে বলেন, বিজনেস টু বিজনেস ফর্মুলায় শ্রমবাজার খুললে ব্যবসায়ীরা সুন্দরভাবে ব্যবসা করতে পারবেন। সবকিছু চূড়ান্ত হলে আগামী নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরের মধ্যে শ্রমিক আসতে পারে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মালয়েশিয়াতে যারা এখনো ইলিগ্যালভাবে আছেন তাদের ব্যাপারে মালয়েশিয়া সরকার আর ভাবছে না। এখন যদি তারা স্বেচ্ছায় না ফিরে যান তাহলে ৬পির ফর্মুলায় পুলিশ তাদের ধরে জেল জরিমানা করে এরপর দেশে ফেরত পাঠাবে। তবে তিনি মনে করেন, অবৈধ শ্রমিকদের বারবার সাধারণ ক্ষমার সুযোগ দেয়া মোটেও ঠিক হবে না। তাহলে আবার আগের মতো অবৈধপথে (সাগর ও আকাশ পথ) লোক আসার হিড়িক পড়বে। এতে দিন দিন সমস্যা আরো বাড়তে থাকবে। সরকারেরও বদনাম হবে।
মালয়েশিয়া থেকে অবৈধ শ্রমিক মেহেদী হাসান গতরাতে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি কলিং ভিসা নিয়ে ফকিরাপুলের রিক্রুটিং এজেন্সি আকাশ ভ্রমনের মাধ্যমে এসেছিলাম। কিন্তু দালালের খপ্পড়ে পড়ে বৈধ হওয়ার সুযোগ থাকলেও তখন পারিনি। এরপর থেকে এদেশে সংগ্রাম করে টিকে আছি। বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমার ১০ মাস ধরে কাজ নেই। পুলিশি অভিযানের কোনো কোম্পানি কাজে রাখছে না। টাকার অভাবে দেশেও ফিরতে পারছি না। তবে আউট পাসে অবৈধদের দেশে ফিরে যেতেই হবে। এখন সেই টাকা কিভাবে জোগাড় করব তা নিয়ে ভাবছি। আমার মতো হাজারো অবৈধ শ্রমিক এখন মালয়েশিয়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
নিউজবাংলা/একে