নিউজবাংলা: ২২আগষ্ট,শনিবার:
ঢাকা: বেদাতি ও পথভ্রষ্টদের ভ্রান্ততা প্রকাশ করা, তাদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, পথ ও মত থেকে মানুষকে সতর্ক করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ইবনে বাত্তাহ (রা.) বলেন, ‘আমি তাদের ভ্রান্ত মতামত এজন্য উল্লেখ করেছি যেন আমাদের ভাইয়েরা জানতে পারেন যে, জাহমি সম্প্রদায় ভ্রষ্টতা, বিভিন্ন ধরনের শিরক, গর্হিত ও মন্দ কাজকর্মের কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের ব্যাপারে যাদের ধারণা নেই তারা যেন তাদের সংশ্রব, সঙ্গ ও ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারে। কেউ যেন তাদের কোনো কথাবার্তায় কান না দেয়।’
মদিনা শরিফের জুমআর খুতবা
বেদাতি ও পথভ্রষ্টদের ভ্রান্ততা প্রকাশ করা, তাদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, পথ ও মত থেকে মানুষকে সতর্ক করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ইবনে বাত্তাহ (রা.) বলেন, ‘আমি তাদের ভ্রান্ত মতামত এজন্য উল্লেখ করেছি যেন আমাদের ভাইয়েরা জানতে পারেন যে, জাহমি সম্প্রদায় ভ্রষ্টতা, বিভিন্ন ধরনের শিরক, গর্হিত ও মন্দ কাজকর্মের কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের ব্যাপারে যাদের ধারণা নেই তারা যেন তাদের সংশ্রব, সঙ্গ ও ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারে। কেউ যেন তাদের কোনো কথাবার্তায় কান না দেয়।’
বর্তমানে একটি পথভ্রষ্ট দল যারা আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণে বিপথগামী। যারা তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সেস্নাগান দিয়ে কিছু মূর্খ, অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন তরুণের হৃদয়কে আন্দোলিত করছে, তাদের বুদ্ধিকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ইসলামিক স্টেট’ নামে এ দলটির আবির্ভাব ঘটেছে এবং যারা ‘আইএস’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
মূলত আইএস হচ্ছে সব মন্দ, অনিষ্ট ও দুষ্কর্মের নাম। তারা ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত। ইসলাম থেকে মানুষকে তাড়াতে ব্যস্ত। ইসলামের শ্রুতি ও চিত্রকে বিকৃত করায় লিপ্ত। তাদের ধারণা, তারা জেহাদের ঝান্ডা ধারণ করেছে। অথচ তাদের জেহাদ হচ্ছে কিছু দুর্গন্ধযুক্ত কাজ, মন্দ কর্ম। যেখানে শুধু হিংস্রতা আর দানবতা। যাদের কাজ শুধু খুন, হত্যা, ধোঁকা, বোমা বিস্ফোরণ এবং অন্যকে কাফের ঘোষণা করা।
তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। ফেতনা ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে দেয়া। দলবদ্ধ জামাতে ভাঙন ও ফাটল সৃষ্টি করা। নিরাপত্তা খর্ব করা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বিরোধিতা আর শত্রুতা করা। মুসলিম মিল্লাতের শত্রুদের সাহায্য-সহযোগিতা করা।
ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুতার একটি বড় দিক হচ্ছে মসজিদে মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ এবং নামাজরত মুসলি্লদের হত্যা করা। সৌদি আরবের আসির এলাকায় মসজিদের মুসলি্লদের ওপর বোমা হামলা তাদের ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য কাজের একটি প্রমাণ। যারা সেই হামলায় নিহত হয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর রহম ও দয়া করুন। তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করুন। আহতদের শেফা ও সুস্থতা দান করুন। তাদের পরিবার-পরিজনের কষ্ট ও দুর্ভোগ লাঘব করুন।
শরিয়ত মূলত মসজিদকে পবিত্র রাখতে ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছে। একে অপবিত্র করা, নাপাক করা হারাম করেছে। পক্ষান্তরে ‘আইএস’ এতে বোমা হামলা করা ও আক্রমণ করা বৈধ করেছে, এর মাঝে থাকা কোরআনের অপদস্থতা জায়েজ করেছে। শরিয়ত নামাজির সামনে দিয়ে যেতে নিষেধ করেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি নামাজের সামনে দিয়ে অতিক্রমকারী ব্যক্তি জানতো তার কী অপরাধ, তাহলে সে সামনে দিয়ে যাওয়া অপেক্ষা সেখানে ৪০ বছর দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম মনে করত।’ অতএব শরিয়ত নামাজ নষ্ট করা হারাম ঘোষণা করেছে। আর ‘আইএস’ নামাজে বিস্ফোরণ ঘটানো এবং এর মাধ্যমে নামাজ ভঙ্গ করা বৈধ করেছে। তারা যেখানেই থাকুক আল্লাহ তাদের হত্যা করুন। তারা সব ধরনের পাপের দ্বার খুলে দিয়েছে। অবৈধভাবে যেনতেনভাবে মানুষকে জবাই করছে। নিরপরাধ ও পবিত্র রক্ত ঝরাচ্ছে। তাই আজারিক ও ছুফরিদের অনুসারী এ বিপথগামী ও বিচ্যুত আইএস থেকে সতর্কতা অবলম্বন করুন। রাসেবি, কুতরি ও জিল খুআইসিরাদের দোসর এ আধুনিক ও নব্য খারেজিদের থেকে দূরে থাকুন।
‘আইএস’ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা কাজে লিপ্ত। এর জন্য তারা তাদের অভ্যন্তরীণ কূটনীতি ও ইচ্ছে অনুযায়ী সৈন্য তৈরি করেছে। অন্যকে কাফের ঘোষণা ও তাদের চিন্তা-চেতনাকে কাজে লাগিয়েছে। নির্বোধ, বোকা, কম বয়সী ও তরুণদের ব্যবহার করছে।
অতীতে ইহুদি আবদুল্লাহ বিন সাবা এ ধরনের পরিকল্পনা করেছিল। খেলাফতে রাশেদা ও মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধে ফন্দি এঁটেছিল। আর সে কাজে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও কালো লোককে ব্যবহার করেছিল। তাদের হৃদয়ে ফেতনার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর সবাই একত্রিত হয়ে রাসুলের শহর মদিনার উদ্দেশে বের হয়। আমিরুল মোমিনিন হজরত ওসমান (রা.) কে হুমকি-ধমকি দেয়। যিনি সত্যবাদী, নেককার ও সম্মানিত মুজাহিদ। যিনি কঠিন সময়ে যুদ্ধ বাহিনী প্রস্তুত করতে হাজার দিনার রাসুলের কোলে ছড়িয়ে দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। যার সম্মানে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘আজকের পর থেকে ওসমান যে কাজই করুক তার কোনো ক্ষতি হবে না।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘কে রোমা কূপ খনন করে দেবে তার জন্য জান্নাত।’ সেই রোমা কূপটিও তিনি খনন করে দিয়েছিলেন। মুসাফির আর মুসলমানদের জন্য তা দান করে দিয়েছিলেন। এছাড়া ওসমান (রা.) এর আরও সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে।
তারা সেই ওসমান (রা.) কে তার ঘরে অবরোধ করেছে। তাকে মসজিদের মেহরাবে নামাজ আদায় করতে বাধা দিয়েছে। অতঃপর তাকে এমন অবস্থায় হত্যা করেছে, যখন তার হাতে কোরআন ছিল। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এ খারেজি সম্প্রদায় সব যুগে ও সর্বসময়ে কত দুষ্ট ও খারাপ ছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ফেতনা ও বিপদ কত ভয়ঙ্কর ছিল।
জেহাদ ইসলামের মূল ও অন্যতম একটি বিষয়। তবে অযথা আত্মঘাতী হামলা, বোমা বিস্ফোরণ করে নিরপরাধ মানুষ হত্যার নাম জেহাদ নয়। অবাদ্ধতা আর বিদ্রোহ করার নাম জেহাদ নয়। মিছিল, বিপ্লব আর উচ্ছৃঙ্খলতার নাম জেহাদ নয়। কোনো ইমাম ও নেতা এবং কোনো ঝান্ডা ও পতাকা ছাড়া ব্যক্তি নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার নাম জেহাদ নয়। জেহাদ এসবকিছুর থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠতর বিষয়।
ইসলাম কোনো দল, সংগঠন, গোষ্ঠী ও জোটের নাম নয়, যার সঙ্গে শত্রুতা ও মিত্রতা করতে হবে। ইসলাম, জেহাদ এবং দাওয়াত আসমানি উচ্চতর একটি রিসালাহ ও বার্তা। যা শুধু মানবতার জন্য ন্যায়পরায়ণতা, দয়া এবং কল্যাণ বহন করে। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা ইসলাম ও জেহাদকে বিকৃত করে উপস্থাপন করতে, ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর মাঝে বিঘ্নতা সৃষ্টি করতে, এর অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করতে এবং যুদ্ধবিগ্রহ ও আপসে সংঘাত সৃষ্টি করতে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে ‘আইএস’ এর মতো অপরাধী সংগঠনকে দাঁড় করিয়েছে। এর উৎকৃষ্ট ও জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে যে, এজাতীয় সংগঠন মুসলিম দেশ ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। ইসলামী দেশগুলোতেই তারা খুন, হত্যা এবং জ্বালাওপোড়াও করছে। এখানেই তারা বিস্ফোরণ, লুণ্ঠন করছে। মুসলিম নারীদের অপহরণ ও গালাগাল করছে। মুসলমানদের সম্পদই গনিমত মনে করে ছিনতাই করছে। রাসুল (সা.) তাদের পরিচয় দিতেই বলেছেন, ‘তারা মুসলমানদের হত্যা করবে, আর মূর্তি পূজকদের ছেড়ে দেবে।’
অতএব হে মুসলিম যুবক ও তরুণ! এ জেহাদি ও তাকফিরি জামাতের ব্যাপারে সতর্ক থাক। এজাতীয় সংগঠন ও দল থেকে দূরে থাক। তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, তাদের পতাকাতলে আশ্রয় নেয়া, তাদের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতাদের হাতে বায়াত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাক। তাদের হাতে বায়াত গ্রহণ করা বিকৃতি ও ভ্রষ্টতা। তাদের আনুগত্য করা গোনাহ, অপরাধ ও অবাধ্যতা।
সত্য ও সুন্নাহের শত্রুরা এ ধরনের সংগঠন ও দলকে নির্ভেজাল ও নিরেট ইসলামী দাওয়াতের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। সৌদি আরবের পথ ও মত এবং এর আলেম-ওলামাদের সম্পৃক্ততার দিকেও ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে আমাদের কিছু লেখক ও বুদ্ধিজীবীও তাদের পথে পা বাড়াচ্ছে। সৌদি আরবের পথ ও মত, এদেশের আলেম-ওলামা এবং এদেশের তরুণরা এধরনের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আমাদের কোনো আলেম ও মুফতির ফতোয়া এ ধরনের ঘৃণ্য কাজকে বৈধ বলে না বা এজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনকে প্রতিষ্ঠা করে না।
আমাদের সবাইকে দায়িত্ব সচেতন হতে হবে। সম্মিলিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের যুবকদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তথা বেকারত্ব, বিপথগামী হওয়া ও মাদকাসক্তি থেকে তাদের রক্ষা করার প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। সন্ত্রাস, বাড়াবাড়ি, উগ্রপন্থা থেকে এবং সন্ত্রাসী ও তাকফিরি গোষ্ঠীর ভয়াবহতা থেকে তাদের বাঁচাতে হবে।
শুধু লেখালেখি আর বক্তৃতা নয়, বরং আমাদের তরুণ ও যুবকরা তার দিকে বেশি মুখাপেক্ষী যে তাদের হাতটা ধরবে। তাদের মাথায় স্নেহের পরশ বোলাবে। তাদের কষ্ট ও মনের কথা শোনবে। তাদের সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করবে। তাদেরকে শেখাবে, সতর্ক করবে। তাদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করবে। সর্বোপরি, তাদের এ পথ ও মত থেকে ফিরিয়ে রাখবে। তাই অভিভাবক ও দায়িত্বশীলদের এভাবেই সামনে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের তরুণ ও যুবকদের এজাতীয় বিপথে যাওয়া থেকে বাঁচাতে হবে।
২৯ শাওয়াল, ১৪৩৬ হিজরি মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার ভাষান্তর করেছেন মহিউদ্দীন ফারুকী
সৌজন্যে : আলোকিত বাংলাদেশ
নিউজবাংলা/একে